২০১০। এস এস সি পরীক্ষা শেষ, হাতে অফুরন্ত অবসর। আগে কখনো এত বড় ছুটি পাইনি, তাই পুরো দিশাহারা অবস্থা। সবেমাত্র কৈশোর পার করার উপক্রম করছি, কি হয়ে গেনুরে ভাব নিয়ে চলি। কি করে সময় কাটাব তার একটা রুটিন করে ফেললাম-বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, তুমুল খেলাধুলা আর সব বন্ধুদের বাড়িতে বেড়ানো। কিন্তু দেখা গেল, আমরা কেউই রুটিন ঠিক রাখতে পারছি না। রুটিনের প্রথম কাজটি বাদে বাকি কাজগুলো প্রায় হচ্ছিলই না, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রথম কাজ, বই নিয়ে ডুবে রইলাম। একসময় দেখা গেল বাড়ীর সব বই-ই পড়ে ফেলেছি! বেহেশতী জেওর থেকে শুরু করে শরৎ রচনাবলী, পাক সার জমিন সাদ বাদ-বাড়িতে যত বই ছিল তার সবগুলোই আমার হাতে অত্যাচারিত হয়েছে।
পরীক্ষার আগে থেকেই একটা ব্যাপারে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, (সত্যি বলতে কি এখনো যে তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি তা না)। হতাশায় মনের মাঝে বৈরাগী ভাব চলে এসেছিল। সারাদিন উদাস উদাস ভাব নিয়ে ঘুরতাম আর বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা, তাই কোন কাজ না পেয়ে আরো বেশি করে হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। হতাশা কাটানোর জন্য বন্ধুদের কাছে হানা দিয়ে ওদের কাছ থেকে বই এনে পড়তে শুরু করলাম, এ পদ্ধতি বেশ কাজে আসল। ধীরে ধীরে হতাশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করলাম।
পৃথীবিতে দুই ধরনের স্বপ্নবাজ আছে-“১.আশাবাদী এবং ২.আশাহীন”। শরৎচন্দ্র ‘দেবদাস’ বইয়ে এ বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
“যাহার আশা আছে সে একরকম করিয়া ভাবে; আর যাহার আশা নাই সে অন্যরকম ভাবে। পূর্বোক্ত ভাবনার মাঝে সজীবতা আছে, সুখ আছে, তৃপ্তি আছে, দুঃখ আছে, উৎকণ্ঠা আছে; তাই মানুষকে শ্রান্ত করিয়া আনে-বেশিক্ষন ভাবিতে পারে না। কিন্তু আশাহীনের সুখ নাই, দুঃখ নাই, উৎকণ্ঠা নাই, অথচ তৃপ্তি আছে। চোখ জলও পড়ে, গভিরতাও আছে-কিন্তু নূতন করিয়া মর্মভেদ করে না। হালকা মেঘের মত যথা-তথা ভাসিয়া চলে। যেখানে বাতাস লাগে না সেখানে দাঁড়ায়; আর যেখানে লাগে সেখান হইতে সরিয়া যায়; তন্ময় মন উদ্বেগহীন চিন্তায় একটা সার্থকতা লাভ করে।”
আমি বোধ হয় দ্বিতীয় দলে পড়ি। এরকম একটি কঠিন কথা এত সহজে, এত শৈল্পিকভাবে বলার জন্য অপরাজেয় কথাশিল্পীকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিবেদন করছি। মানুষের মুখের সামান্য কথাকেও যে শিল্পের পর্যায়ে নেওয়া যায় এটা শরৎচন্দ্রের বই না পড়লে জানতেই পারতাম না।
সুখ জিনিসটা আপেক্ষিক, একেকজনের কাছে এর সংজ্ঞা একেক রকম। মানুষ মাত্রই সুখের কাঙ্গাল, আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। তাই সুখের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়ছি এখান থেকে ওখানে, এক মানুষের কাছ থেকে আরেক মানুষের কাছে। কিন্তু নির্মল সুখ খুব কমই প্যেছি। তাই সংজ্ঞা খুঁজে বেড়িয়েছি বিভিন্ন লেখকের বইয়ে। কোথাও মনের মত উত্তর পাইনি। তবে সুখের সংজ্ঞা না পেলেও বুদ্ধদেব গুহের “অভিলাষ” বইয়ে সুখ নিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। “অভিলাষ” বইয়ের এক জায়গায় আছে-
“মানুষের জীবনটা ছোট্ট। এই জীবনে সকলেরই সুখে থাকাটা বড্ডই দরকার। একজন মানুষের উপরে তো অন্য মানুষের সুখ নির্ভর করে না। অন্য একজন হোকই না আমার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে সুখী। আমি অন্য মেয়ে দেখে নেব। সুখের অভাব কোথায়|? এই চাঁদের আলোরই মত, শিমুলের বীজ ফাটা তুলোরই মত, সুখতো ভেসে বেড়াচ্ছে সব দিশুম-এ। হাত বাড়ালেই হল। ওর জন্য অত মারামারিরই বা দরকারটা কি? আমার ভালবাসারমানুষ, আর ও যাকে ভালবাসে তার অসুখ হলে কি আমার সুখ হত? তবে? এই হচ্ছে আসল কথা। শুধু নিজের সুখ হিলেই সুখ হয় না। সললে সুখী হলেই আসল সুখ।”
বইটা পড়ে মানুষ, মানুষের মন ও জীবনের অন্রক অজানা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথাই জানতে পারলাম। জীবনে কি করে বাঁচতে হয় সে সম্পর্কে কিছুটা হলেও শিখতে পেরেছি। তাই জীবনটাকে উপভোগ করতে চেষ্টা করছি। পরে হয়তোবা এ সুবর্ণ সুযোগ আর পাব না। কারণ এক একটি দিন যাচ্ছে আর জীবন থেকে একটি করে দিন ঝরে যাচ্ছে অর্থাৎ, প্রতিদিন মৃত্যুর এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি।
(২’রা এপ্রিল, ২০১০)