একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য খুবই প্রিয়, আমরা ঘরে বাত্তি জ্বালাই না; জ্বালাই মসজিদে। এই প্রবাদটুকু খুবই বাস্তবসম্মত এবং আমাদের অভ্যাস থেকেই এসেছে। খেয়াল করে দেখুন বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপনি বিশ্বাস করেন পরকে আর সন্দিহান থাকেন নিজের বেলায়। এর অর্থ হলো আমরা জাতিগতভাবেই “আত্মবিশ্বাসী” নই। যেকোন ব্যাপারেই আমরা চরম সন্দিহান এবং সেই সাথে চরম নেগেটিভ মনের অধিকারী। এই সমাজে যে কারো নামে যদি একটা সন্দিহান বা গুজব রটানো যায় এবার সেটি থেকে বাচ্চা বের না করা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নাই। সেটা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমনকি আমি নিজেও এই ধরণের হয়ে থাকি। কিছু উদাহারণ এখানে আগে টেনে আনি এরপর না হয় মূল কথায় যাবো। শুরুতেই চলে যাই আমাদের বাঙালিত্বের গোড়াপত্তনে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে। সেই সময়ে পাকিস্তান, জামায়াত এবং তাদের দোসরদের চরম প্রপাগান্ডায় আমরা বিভক্ত হয়ে পড়ি। একদল চেয়েছিলাম স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, সার্বভৌমত্ব এবং অন্যদল চেয়েছিল অখন্ড পাকিস্তান ও তথাকথিত ইসলাম রক্ষা!!! আমাদের প্রবল মনোবল, আত্মবিশ্বাস এবং সৃষ্টিকর্তার স্বদিচ্ছার ফলে মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় শাসকগোষ্ঠী যার ফলে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, পেয়েছিলাম বাংলাদেশ। কিন্তু আজ ৪৩ বছরে এসেও আমরা দূর করতে পারিনি সেই সময়ের প্রপাগান্ডা সমূহ, দূর করতে পারিনি সন্দেহগুলো। যার ফলে গিয়ে এখনো মাঝে মাঝেই রব উঠে ধর্ম বাচানোর। যখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই তখনই ঐ পরাজিত শক্তিগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে আমরা গেয়ে উঠি ধর্ম বাঁচাও বলে। অর্থাৎ আমরা আদৌ পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস এবং আস্থা আনতে পারিনা আমাদের স্বাধীনতায়। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রসঙ্গে ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন করে কিছু বলার অবকাশ রাখে না যে, তারা নিজেদের বাঁচাতেই ধর্মের অপব্যবহার করছে এবং এসব আমরা জোর গলায় বলতেও দ্বিধা বোধ করি।
এরপরে আসুন আমাদের গোলামিপনায়। ২০০ বছর ইংরেজদের গোলামি খেটে খেটে আমাদের জ্বিনে গোলামিত্ব গেঁথে গেছে, এই গোলামিত্ব আমরা ছাড়তে পারি নাই এখনো পর্যন্ত। যে কোন ইস্যুতেই আমরা স্বদেশ ছেড়ে বিদেশীদের পছন্দ করি একটু বেশি করেই। আমরা পছন্দ করি না টিনের চালের ঘর, গোলপাতার ছাউনি ঘর। আমরা পছন্দ করি অট্টালিকা, পছন্দ করি ফ্ল্যাট। আমরা পছন্দ করি না দেশী মিষ্টি, পছন্দ করি দিল্লির লাড্ডু। পছন্দ করি না ঢালিউড, পছন্দ করি বলিউড বা হলিউড। এমনকি শিক্ষার ক্ষেত্রেও উক্তিতে প্রাধান্য দেই এরিস্টটলকে কিন্তু টেনে আনিনা আরজ আলী মাতুব্বরকে। অনেকে জানেও না কে এই আরজ আলী মাতুব্বর, কি তার দর্শন। খুব বেশি জোর হিসেবে চিনি তথাকথিত নাস্তিক হিসেবে। আমরা ভালো করে জানিনা আমাদের দেশীয় ফুটবল টিমে খেলোয়াড়দের নাম কি কি, ভালো করেই মুখস্থ করি কোস্টারিকা বা হন্ডুরাসের খেলোয়াড়দের নাম, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কথা না হয় বাদই দিলাম। পছন্দ করি না দেশী গান, পছন্দ করি মুন্নী বদনাম বা লুঙ্গি ডেন্স। অবশ্য দুই একটি ব্যাপারে দেশী জিনিস হলে একটু গর্ববোধ করি, এই যেমন ধরেন দেশী মুরগী, দেশী কৈ, দেশী গরু, দেশী পেঁয়াজ ইত্যাদি।
এবার আসুন মূল প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের জান – বাংলাদেশের প্রাণ – সাকিব আল হাসান। হুমায়ুন আজাদ তার “রাজনীতিবিদগণ” বইটিতে আমাদের, অর্থাৎ সাধারণ জনগণকে বর্ণণা করেছেন চমৎকারভাবে আর উপাধি দিয়েছেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর হিসেবে। কেননা এই আমরাই মানুষকে উঠাই আবার ধাপ করে এতো নিচে নামাই যে সে আর উঠতে চাইলেও পারবে না। এই উঠা-নামায় আমরা ভীষণ এক্সপার্ট এক জাতি। এই সাকিবকে কয়দিন আগে কেইবা চিনতো, অথচ সে তার যোগ্যতা বলে আজ সমগ্র বিশ্বে নন্দিত। অবশ্য এই মুহুর্তে নিজের মাটিতে “নিন্দিত”। এখানে আবার আরেকটু বলে রাখা ভালো জাতি হিসেবে আমাদের একটা খ্যাতি আছে, হুজুগে বাঙালি নামে। আমরা শোনা কথায় কান দেই আর তিলকে তাল বানাই। চ্যালেঞ্জ করেই বলতে পারবো সাকিবের নিন্দা চর্চায় মূখর অধিকাংশই জানেন না মূল কাহিনী কি। যতটুকু জানেন কারো লেখা পড়ে, কারো মুখে শুনে কিনবা বাতাসে আওয়াজ পেয়ে। অবশ্য আমাদের ক্ষমতা হচ্ছে এই পর্যন্ত পড়া, শোনা আর আওয়াজ পাওয়া। ছোট বেলা থেকেই তো বড় হয়েছি “মন দিয়ে পড়া-শোনা করো” জেনে জেনে। আর এজন্যই আমরা পড়া আর শোনাকে প্রাধান্য দেই বেশি নিজের দেখা চাইতেও। আমিও যতটুকু পড়েছি, শুনেছি এবং দেখেছি তা হলো, সাকিব-আল-হাসান ক্যারিবিয়ান লীগে খেলতে যাওয়ার আগে চেয়্যারম্যান আকরাম খান সাহেব থেকে অনুমতি চেয়েছিল। আকরাম খান সাহেব চট্টগ্রাম অবস্থান করাতে বলেছিলেন আবেদনপত্র জমা দিয়ে সাকিব-আল-হাসান যেন খেলায় অংশ নিতে চলে যায়। সাকিবও চেয়্যারম্যান সাহেবের মৌখিক অনুমতি পেয়ে বিমানে চেপে লন্ডন পৌঁছে গেলো। কিন্তু এইদিকে কয়দিন পরেই দেশের মাটিতে খেলা আর তাই অনুশীলন ক্যাম্পে থাকতেই হবে বাংলাদেশের এই জান-প্রাণকে। তাই কোচ হাথুরু সিং সাহেব অস্ট্রেলিয়া বসে কল করলেন লন্ডনে, হুকুম দিলেন ফিরে আসতে হবে সাকিবকে। হয়তো তাদের কথাবার্তায় একটু এদিক-সেদিক হয়েছিল তাই সাকিব বলেছিল সে আর খেলবে না। ব্যস এই উত্তরটা হাথুরু সাহেব জানিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষকে আর কর্তৃপক্ষ থেকে সেটা মিডিয়াতে এবং মিডিয়া থেকে সেটা পুরো দেশে। এরপর শুরু হয়ে গেলো সাকিব আল হাসানের আকিকা উৎসব। মোটামুটি তার নাম বদলেই ছাড়বো এমন একটা ভাব নিয়ে লেগে পড়লাম আমরা, বিলেত থেকে সাকিব ফেরার আগেই এই কর্ম সম্পাদন করা চাইই চাই। আবার কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে নিজেদের মর্দ, ব্যাডা (হেফাজত পরিভাষায়) প্রমাণে সাকিবের বউ নিয়েও নিজেদের সোন্দর মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি, অবশ্য শিশির তো আমাদের ভাবী লাগে আর তাছাড়াও সে তো আর আমাদের মা-বোন না। তাই তারে নিয়ে মন্তব্য, একটু-আধটু টিজ করতেই পারে মর্দ বা ব্যাডারা। প্লীজ এই ব্যাপারটা নিয়ে নারীর মান-সম্মান টাইপ কোন ইস্যু টেনে আনবেন না। জানেনই তো এইদেশে যাবতীয় দোষ হয় নারীদের, ধর্ষক পুরুষের কোনই দোষ নাই, এই সমাজে ধর্ষণ ইন্ডিরেক্টলি জায়েজ।
তো উপরে যে বলেছিলাম আমরা ঘরে বাত্তি জ্বালাই না মসজিদে জ্বালাই, এই প্রবাদটা প্রমাণ হয় যখন আমরা বিশ্বাস করি হাথুরু সিং এর কথা সত্য এবং সাকিব দোষী বলে সাফাই দেই। এক পক্ষের কথা শুনেই আমরা বিচার করে ফেলেছি, সাকিবের কথা শুনলামই না। এইবার ফুটবল বিশ্বকাপের একটা খেলায় আর্জেন্টিনার এক খেলোয়াড় তার কোচের মুখে পানি মেরেছিল, সেটা নিশ্চয়ই কারো নজর এড়ায় নাই। কই সেই কোচ কিনবা ফিফা কি সেই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিয়েছিলো? নাকি আমরা সেটা নিয়ে কোন মন্তব্য করেছিলাম? বরং বলেছি যে কোচের সাথে খেলোয়াড়দের একটা সু-সম্পর্ক আছে বলেই আজকের দিনে আর্জেন্টিনা এতোদূর এগিয়ে আসতে পেরেছে। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে আমরা এইসকল আপোষ, প্রেম-ভালোবাসা দেখতে পাই কিন্তু দেখতে পাই না নিজেদের বেলাতে। হুমায়ুন আজাদ অবশ্য বলে গিয়েছেন প্রতিটি পরিবারের কর্তা পুরুষটি একেকজন মিনি ডিক্টেটর এবং প্রবাদ বাক্য বলে “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”। আমাদের জানার দরকার নেই সাকিব কিভাবে বলেছে, যতটুকু জেনেছি এতেই সাকিবকে দন্ড দিতে উদ্যত আমরা। জানার দরকারও অনুভব করিনি একবারের জন্যেও বিদেশী হাথুরু সিং কতটা সত্য বলেছে, কিনবা সেই বিসিবি কতটা সত্য বলছে যার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার আন্দোলন করেছিলাম আমরা। অবশ্য আমাদের অভ্যাসই তো এটা মিডিয়া যাই বলবে তাতেই বিশ্বাস করে ল্যাজ উঁচিয়ে দৌঁড়ানো। আমরা কি জানতে চেয়েছি হাথুরু সিং এইদেশের কোচ হয়ে অনুশীলনের পূর্বে অস্ট্রেলিয়ায় কি করছেন? জানতে চাইনি, তবুও মিডিয়া জানিয়েছিল হাথুরু সিং অস্ট্রেলিয়াতে। এর বাইরে আর কিছুই জানালোনা তারা আর আমরাও জানতে চাই নি। অথচ আমরা সাকিব কেন লন্ডনে সেটি জানতে না চেয়েও জেনে গেছি মিডিয়া, বিসিবি আর হাথুরু সিং এর কল্যানে। অনেকেই হয়তো বলবেন এই মুহুর্তে বিভেদ তৈরী করে দিচ্ছি কোচ আর খেলোয়াড়দের মাঝে, কিন্তু বাস্তব সত্যটা হলো দূরত্ব স্বয়ং কোচ নিজেই তৈরী করে নিয়েছেন। কোচের অবাধ্য হতে চাওয়া মানে কোচ ব্যর্থ, এটি তার নেতৃত্বের ব্যর্থতা। ভুলে গেলে চলবে না, পুরো টিমের মাঝে একটা ভালো বোঝাপড়া আছে। তারা দলবদ্ধ হয়ে ছিলো, আছে এবং থাকবে, মাঝখান থেকে কাউকে অহেতুক, ঠুনকো কারণে বাদ করে দিলে সেটি কোনভাবেই মঙ্গলকর হবে না।
গতকাল মিডিয়াতেই দেখেছি সাকিব লন্ডন থেকে ফিরে সুন্দর করে তার বিবৃতি দিয়েছে। বক্তব্যের কোথাও কথিত “বেয়াদব”-এর ন্যায় আচরণ করেনি সাকিব। ফলে তাকে যারা বেয়াদব, অসভ্য, অহংকারী ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করেছে নিঃসন্দেহে তাদের জন্য একটা দারুণ চপেটাঘাত হয়ে থাকবে সাকিব আল হাসানের গতকালের বিবৃতিগুলো। আজকে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে বিসিবি, জানিনা সিদ্ধান্ত কি নিবে,(এইমাত্র জানলাম ছ’মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে) তবে এইটুকু বলি সাকিব আল হাসান বিশ্বের বুকে আমাদের মাথা উঁচু করেছে। আমাদের জন্য এনেছে বিরল সম্মান, ইতিহাসের পাতায় সাকিবের জন্যে হলেও বাংলাদেশের নামটি লিখিত থাকবে। ক্রীড়াপ্রেমী বহু লোক বাংলাদেশকে চিনতো না অথচ এই সাকিবের জন্যেই চিনেছে, চিনবে। বলবে “ঐ দেখো, ওটা সাকিব আল হাসান। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার, সে বাংলাদেশে থাকে।” আমি অন্তত এইটুকু বিশ্বাস করি সাকিব আর যাই করুক না কেনো, এই দেশটাকে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে আমাদের ন্যায়, সে আর যাই হোক, ভালোবাসে স্বাধীন বাংলাদেশটিকে। সে অন্তত পরাজিতশক্তির দালাল নয়, কেননা তার মাঝে এখনো পর্যন্ত সেইরকম কিছু পরিলক্ষিত হয়নি। তাই তাকে “লোভী“, “স্বার্থবাদী“, “বেঈমান” এইসকল ট্যাগ দিতে অপারগ।
মর্মান্তিক!
সাকিব আল হাসান কে
মর্মান্তিক!
সাকিব আল হাসান কে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হুম, এই মাত্র জানলাম। ভীষণ
হুম, এই মাত্র জানলাম। ভীষণ মর্মান্তিক। যদি সাকিব শাস্তি পায় তাহলে আকরাম খানকেও শাস্তি পেতে হবে।
তৃতীয়বার কমেন্টস করছি- হনুদের
তৃতীয়বার কমেন্টস করছি- হনুদের ট্রিটমেন্টের জন্য শাস্তিটা প্রযোজ্য। আশা করি ৬মাসে হনু আমজনতার আবেগকে বুঝতে শিখবে।
সহমত
সহমত