১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ !!!! ৭৪ থেকে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬!!!! বাংলাদেশে মাত্র ১৩ বছরে সংখ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে মেধাবীর সংখ্যা বেড়েছে ১৯২২ গুণ !!! বিস্ময়কর!!! প্রত্যেক বছরে আজকের মত রেজাল্ট বের হবার দিনগুলোতে আমরা টের পাই আমাদের মেধাবীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । আমরা শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছি জ্যামিতিক হারে। আর এই দিনগুলোতে পত্রিকাওয়ালারা গর্ব করে লাল বোল্ড হরফে ছাপাচ্ছে এ প্লাস সমাচার। স্কুল- কলেজগুলোতে আনন্দের বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে এ প্লাস ধারী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা। আর আনন্দ সংক্রামক বলে আমরা তার সাথে বিপুল আনন্দে আনন্দিত হচ্ছি। ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে বলে আমাদের আনন্দ ধরাকে সরা জ্ঞান করে উড়তে থাকছি আকাশে ও বাতাসে।
কিন্তু আসলেই কি আনন্দময় ?
খুব অতীতে না গিয়ে গত দুই মাসের ঘটনার দিকে তাকালেই এর উত্তরটা মেলে।
১) মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রায় বেশীরভাগ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে ।
২) চলতি বছরের চলতি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
৩) চটজলদি পদক্ষেপ হিসেবে কেবলমাত্র ইংরেজী ২য় পত্র পরীক্ষাটি বাতিল হয়েছে। আর কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
এখন আরেকটু গভীরে যাই। প্রশ্নপত্র ফাঁস ব্যাপারটা নতুন না হলেও গত কয়েক বছরে বিশেষ করে এই দুই বছরে যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে সেই ব্যাপারটা একদম নতুন। এবং এই ব্যাপারটাকে মহামারী বলা যেতে পারে । মহামারী এই কারণেই কেননা, এই ব্যাপারটা যদি লাগামহীন ভাবে চলতে থাকে তবে শিক্ষার দূর্ভিক্ষ হতে আর বেশী দিন লাগবেনা।
কিন্তু কেন ? প্রশনপত্রের ফাঁসের মত ফাঁসের মত এই অনৈতিক কাজটা হচ্ছেই বা কেন ? আর কিভাবেই হচ্ছে ? আর কারাই বা এর মূল হোতা?
উত্তরটা কিন্তু আমাদের সবার জানা এমনকি নখদর্পণে। আসেন একটু মিলিয়ে নেয়া যাক।
ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দা পড়েনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। কাজেই কিশোর, মুসা, রবিন কে চেনা আছে সবার। এমনকি “ভূত থেকে ভূতে ” নামক যে পদ্ধতির মাধ্যমে তিন গোয়েন্দা বিপদ বার্তা ছড়িয়ে দিত সবার মাঝে সেটাও নিশ্চয়ই এখনো বিস্মৃত হয়নি । যদি বিস্মৃত না হয়ে থাকে তাহলে এই পদ্ধতিটার কথা একটু ভেবে দেখেন । এই পদ্ধতিটাই হলো ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে যাবার সবচেয়ে কার্কযর পদ্ধতি । আর এখানে নিয়ামক, নিয়ন্ত্রক সবকিছুর ভূমিকা পালন করছে ফেসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং কতিপয় অসাধু ফটোকপি মেশিন! কিন্ত যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসই না হতো, তাহলে?
তাহলে নিশ্চয়ই এই পদ্ধতিটাই অকেজো হয়ে যেত।
এবং প্রশ্নপত্র যদিই ফাঁসই না হতো তাহলে শিক্ষার্থীরাও আর পরীক্ষার আগে বা পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে থাকতোনা ।
যাইহোক, “এবার কারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ?” এই প্রশ্নটার একটা উত্তর খোঁজা যাক।
বাংলাদেশে কিভাবে প্রশ্ন তৈরী করা হয় এবং কিভাবে এর নিরাপত্তা রক্ষা করা হয় সে সম্পর্কে আমার একদম স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য ধারণা নেই তবে এতটুকু জানি প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক একটা কমিটি গঠন করা হয় । বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন করার জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় এবং কম্পোজ সহ আরো কারিগরি কাজের জন্য আরেকদল কারিগর নিয়োজিত থাকে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে প্রশ্নপত্র ফাঁস এই সব লোকদের কাছ থেকেই হয় ।
কিন্তু কেন ???
প্রথমত, যারা প্রশ্ন করে সেই সব শিক্ষকদের কাছে আসি । তারা যেহেতু শিক্ষক, জাতির মূল বুদ্ধিবৃত্তিক চালিকা শক্তি, তাহলে তারা এই কাজ কেন করবে? তাদের মূল্যবোধ, তাদের নীতিজ্ঞান এসব কোথায় গেল তাহলে?
এইখানে খুব সম্ভবত তিনটি কারণ কাজ করে।
১) মানবিক লোভ
২) অর্থনৈতিক লোভ
৩) সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার লোভ
দেখেন, আমাদের সবারই জেনেটিক একটা ব্যাপার আমরা লোভী। ভালবাসা পাওয়ার প্রতি আমার লোভ, সম্মান পাবার প্রতি আমাদের লোভ, বিখ্যাত হবার প্রতি আমাদের লোভ। এইরকম হাজারটা লোভ নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি, শিক্ষকেরা কেন থাকবেনা? কাজেই তারা নিজের তৈরী প্রশ্নপত্র নিজের কোন প্রিয় ছাত্রকে দেয় ভালবাসা পাবার জন্য (!!!!) , তার প্রতি একটা শ্রদ্ধার দৃষ্টির জন্য (!!!!!!) এমনকি অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবার জন্য তারা প্রশ্ন বিক্রি করে বেশ চড়া দামে এবং এটার যে আউটপুটটা আসে সেটাও বেশ লাভজনক কেননা ঐ শিক্ষকদের ছাত্ররা যখন জিপিএ ৫ পায় তখন তার বেশ প্রসার হয়, সামাজিক ভাবে সম্মান বাড়ে, প্রাইভেট টিউশনিতে টু পাইস ইনকাম বাড়ে এমন কত কি! এবং এর সাথে এই অনৈতিক কাজের জন্য কোন জবাবদিহিতার ক্ষেত্র না থাকায় আখেরে তাদের নিট প্রফিট এতটা আসে খুব অবাক লাগে সেটার দিকে তাকালেও।
এবার, একটা চক্রের কথা বলে যাক। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবার আগে কতগুলো পরীক্ষার্থী কে নিয়ে মিরপুর ১০ নাম্বারে বসে ছিলাম এবং চুপচাপ ওদের আলোচনা শুনছিলাম। ওদের আলোচনার বিষয় ছিল প্রশ্ন কিভাবে পাওয়া যায়। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে কাকে কাকে যেন ফোন দিয়ে প্রশ্ন পাওয়ার একটা সোর্স বের করে ফেলল। দরদাম ও করে ফেলল। পরীক্ষার আগের রাতে সোর্সটা ওদের প্রশ্ন দেবে, বিনিময়ে ১২০০০ টকা। ফেসবুকেও এই সম্পর্কিত কিছু পেজ আছে যেখানে ঠিক এইরকম কথাই বলা হয়। কাজেই, এটা খুব স্পষ্ট এইরকম অনেক চক্র সারাদেশে তাদের কার্যক্রম চালায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এইসব চক্র নিয়ন্ত্রণ করে কে ? আমি যদি বলি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দায়িত্বরত শিক্ষকেরা এইসব নিয়ন্ত্রণ করে- তাহলে কি সেটা খুব অসত্য কিছু হবে ???
যেহেতু, এটা অসত্য না, সেহেতু এটার সমস্ত দায়ভার মাথার। আপনি যদি মন্ত্রালয় থেকে এটার বিরুদ্ধে খুব শক্ত কোন পদক্ষেপ নিতে না পারেন, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং এটার সাথে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য কোনভাবেই রোখা সম্ভব না।
সংকটের জায়গা: অভিভাবকদের ইনফিয়িরটি কমপ্লেক্স , আইডেনটিটি ক্রাইসিস ও শ্রেণীগত গরিমা
ইনফিয়রিটি কমপ্লেক্স শব্দটার সাথে নিশ্চয়ই সবার পরিচয় আছে। কিছুদিন আগে একজন বলেছিলেন , “ সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স বলে আসলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, এটা ইনফিয়িরটি কমপ্লেক্সের একটা বহিঃপ্রকাশ । ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। আসলেই সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয় কেননা যারা ইনফিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে কেবল মাত্র তারাই সময় অসময় সুপরিয়রিটি কমপ্লেক্স দেখায়। যাইহোক, এবার দেখা যাক প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে ব্যাপারটা কিভাবে জড়িত।
১) ভাবী, আমার ছেলে না গোল্ডেন এ প্লাস পাইছে
২) জানিস, আমি না গোল্ডেন এ প্লাস পাইছি, মায়ে বেজায় খুশী, সবাইরে কয়ে বেড়াইতেছে ।
কথাটা খুব সাধারণ, কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই কথাটা বলার মানসিকতাটা খুব ভয়ানক । কেননা, বর্তমান সামাজিক ব্যাবস্থায় এই কথা বা ছেলে মেয়ের ভাল রেজাল্ট করা বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজের চলতি স্ট্যাসাসের জন্য খুব কার্যকর নির্ণায়ক । যেহেতু, আমাদের অভিভাবকদের বেশ বড় অংশ একই সাথে ইনফিয়রিটি কমপ্লেক্স ও আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগেন কাজেই সমাজে তাদের স্ট্যাটাস নিয়ে তাদেরকে সচেতন থাকতে হয় এবং শুধুমাত্র এই কারণে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিতে তারা যেমন সন্তান কে আপত্তি করেননা তেমনি প্রশ্ন পাওয়ার সোর্সের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন নিয়ে এসে সন্তানকে দিতে কুন্ঠাবোধ করেননা। কিন্তু ব্যাপারটা যে কতটা ভয়ানক, অন্তত সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় এবং কর্মক্ষেত্রের সীমাহীন দুর্গতি দেখে একবার হলেও তাদের অনুধাবন করা উচিত।
১৪২২৭৬!!!!!! একটা বিদ্রুপ !!
ক্রমাগত প্রশ্নপত্র ফাঁস , অপভাবকদের অনৈতিক অপাচার এবং সরকারের সামগ্রিক নীরবতার ফসল এই ১৪২২৭৬!! প্রকৃত মেধাবী এবং আগ্রহীদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি, যারা এই সংখ্যাটির অধীনস্ত হয়ে আজ হুল্লোড় করছে তাদের যেমন সঠিক মূল্যয়ন হয়নি তেমনি সঠিক মূল্যয়ন হয়নি যারা আজ এই সংখ্যাটার অন্তর্গত নয়। আমি হলফ করে বলতে পারি , আমাদের এই সামগ্রিক শিক্ষা ব্যাবস্থাটা যদি শুদ্ধ হতো , আনন্দময় হতো, টাকশালের হাতের পুতুল না হতো তাহলে যারা আজ অকৃতকার্য হয়েছে তাদের মধ্যে থেকেও বের হয়ে আসত অনেক সম্ভাবনাময় মেধাবী যাদের স্বপ্নের মুঠোয় আগামীর পৃথিবী।
তাই যারা অকৃতকার্য হয়েছে তাদের তথাকথিত ইনফিয়রিটি কমপ্লক্সে ভোগার কোন যৌক্তিকতা নেই, এবং আমাদের প্রত্যকের উচিত হবে এই যে শুধু এ প্লাস ধারীদের প্রশংসা না করে যারা পুরো সিস্টেমের বলি হয়েছে যেইসব শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা । খুব সম্ভবত, এইসব বঞ্চিতরা আমাদের কাছ থেকে এর বেশী কিছু আশা করেনা।
পোস্টটা স্টিকি হওয়া দরকার।
পোস্টটা স্টিকি হওয়া দরকার।
স্টিকি হওয়া দরকার মানে ?
স্টিকি হওয়া দরকার মানে ?
হুম
হুম :মাথাঠুকি: