আমি সমসাময়িক রাজনীতির কথা বলছি না । অসাধারণ এক জীবনের সাধারণ প্রসঙ্গে এসে আমার মুখের ভাত গলায় আটকিয়ে গেছে । রাজনীতিতে ডানপন্থী আর বামপন্থীর বিভাজনে বিচ্ছেদে কোনও জটিলতা নেই । কেন্দ্রে যারা ক্ষমতাসীন তারা ডানপন্থী । সেই ক্ষমতা থেকে যারা টাল খাইয়ে ফেলে দিতে চান তারা বামপন্থী । খুবই সোজা হিসেব। বামপন্থা মানে প্রতিবাদ,মিছিল,ধর্মঘট,দেয়াললিখন,পথসভা,উগ্রভাষণ এবং কেন্দ্রের সমালোচনা । বামপন্থী মানে ক্রোধী ও উগ্রস্বভাবের একদল নারী-পুরুষ যাদের স্লোগান হল ভেঙ্গে দাও ! গুড়িয়ে দাও ! বামপন্থা মানে বিপ্লবহীন বিপ্লব । এক ধরনের রোমান্টিকতা । মধ্যবিত্তের ভাবনা- আমরা সর্বহারা,আমরা নিপীড়িত,আমরা শোষিত,নিরন্ন । হয়ত ক্ষমতার আসনে বসে আছি । মার্সিডিস চাপছি ।গুলশান বনানীতে স্ত্রী কন্যা নিয়ে থাকছি । মেয়েরা মাস্টারমাইন্ডে পড়ে।বোমার্স ক্যাফেতে খাচ্ছি তবুও অন্তরের ভেতর বসে গাঁজা খেয়ে যাচ্ছে তৈলহীন,রুক্ষ,ফ্যাকাশে এক সত্তা । ক্ষমতার আসনে বসে থেকেও তাঁর মনে হচ্ছে সে বসে আছে ফুটপাতে,খুপড়িতে,ঝুপড়িতে । সুকোমল আক্তার মেট্রেসে শুয়েও তাঁর মনে হচ্ছে সে শুয়ে আছে আবাহনী মাঠের সাইডের ফুটপাতে সরকারী দলের ব্যানার বিছিয়ে শুয়ে আছে । কঙ্কালসার স্ত্রী খুকখুক করে কাশছে । ঘ্যাঁসর ঘ্যাঁসর করে সে চুলকিয়ে যাচ্ছে তাঁর শরীর ।ফুটপাতে পা চাপা দিয়ে ফেলে রাখা সিগারেটের মোথা নিয়ে খেলছে একগাদা উদাম ন্যাংলা-ন্যাংটা ছেলেমেয়েরা ।
হয়ত খেতে বসেছে বোয়ালের ঝোল আর চিকেন কারি নিয়ে তবুও ভেতরের সত্তা সে সব গ্রহন করবে না। মুখে খোচাখোচা দাড়ি নিয়ে উপবাসীই থাকবে । এই আত্নিক হাহাকারই হল বামপন্থা । প্রচলিত ব্যবস্থা ভেতর থেকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার নামই বামপন্থা। এই মনোভাব থেকেই জাগ্রত হবে বিদ্রোহী চেতনা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক মানুষকে মনে হবে ঘুষখোর,দুর্নীতিবাজ,সুবিধাভোগী শয়তান । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মনে হবে চামচা,দালাল এবং একগাদা ক্রীতদাস তৈরির আখড়া । ধর্মকে মনে হবে দরিদ্রের আফিম । শ্রমপ্রতিষ্ঠান চোখে পড়লে মনে হতে থাকবে শোষণের যাঁতাকলের যন্ত্র ।
একালের প্রবীণ মাতাপিতারা সেই আদিম খৈ,দাপট হারিয়ে ফেলেছেন । পরিবারের গুড বয়রা এখন আর নেই । মাতাপিতারা এখন একালের মেয়েছেলের কাছে ঘৃণিত ডানপন্থী । তাঁরা হলেন এখন শুধুই সদাসমালোচিত কেন্দ্রের মতন । পুত্র কন্যারা হল এখন পুরোপুরি বামপন্থী । বাইরে তাঁরা কিছু না ভাঙ্গতে পারলেও ভেতরে তাঁরা সাফল্যের সাথে ভাঙ্গতে পেরেছে । প্রকৃত বিপ্লব চুপিসারে পরিবারে পরিবারেই ঘটে গেছে । এইম ইন লাইফ মুখস্ত করে থাকলেও এখন এটা বলতে কিচ্ছু নেই একালের যুবকদের । সবার লক্ষ্য এখন অলক্ষ্য । একালের যুবকদের কোনো অবিভাবক নেই সুতরাং বশ্যতা স্বীকার করার মানসিকতাও নেই । একালের যুবকরা খেতে গেলে মারামারি করে ,হাটার সময় মারামারি করে,খেলার মাঠে মারামারি করে,প্রেম নিয়ে মারামারিকরে, বাসের কন্টাকটারের সাথে মারামারি করে ।
অবিভাবক বলতে একালের যুবকদের আছে কিছু ” বড়ভাই ” । সেকালের যুবকদের একটা চক্ষুলজ্জা ছিল । অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত তাঁরা পরিবারের প্রভুত্ব মেনে নিত “ভাসাল স্টেট ” এর মত । তাঁদের গাদা গাদা রচনা না মুখস্ত হলেও ঠিকই মুখস্ত হত – পড়াশনা না করলে ভাল চাকরী হবে না, টাকা হবে না,গাড়ি বাড়ি হবে না । সেকালের যুবকদেরকে পাশের বাড়ির মেধাবী ছাত্র কদুর মত করে জোরে জোরে গলা ছেড়ে পড়তে হত নইলে যে মুখস্ত হবে না আর মুখস্ত না হলে মায়ের কাছে পড়া দিতে পারবে না, ক্লাসে শিক্ষক মারবে । একালের যুবকরা সরাসরি বলে বসে জেদ দিয়ে এখন পড়তে পারব না । যখন খুশি ঘুম থেকে ওঠ।ইচ্ছে হলে পরা নইলে না। টিভি দেখ নইলে গ্যালাক্সি এস ত্রিতা হাতে নিয়ে রাস্তার মোড়ে রাখা ইটের স্তূপের উপর বসে বন্ধুদের নিয়ে হিন্দি গান শোনা। একালের যুবকরা অবৈধ বেত্রাঘতের সময় শিক্ষকের সামনে নতুন আইনের পেপার কাটিং তুলে ধরে । বামমার্গিরা প্রায়শই বলে থাকেন কার্যালয় ঘেরাও । গৃহকার্যালয় অনেক আগেই চলে গেছে যুবকদের দখলে । সেখানে বাপ মা নামক অবুঝ দুটো ডিকটেটর থাকেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপের নির্বাসিত জীবনের মত । ডিকটেটরের দিন শেষ, গণতন্ত্রেও বিশ্বাস নেই। কোন শাসন নেই । পড়ার টেবিলের সামনে ভাতের আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা ডেইলি রুটিন নেই ।
একালের যুবকদের এখন ধর্মেও অবিশ্বাস । ৯০ ভাগ যুবকের গলায় এখন আর পইতে নেই । নেই মাথায় টুপি । গঙ্গা তীরবর্তী সুরম্য মন্দির এখন হয়ে উঠেছে প্রেমকুঞ্জ । শাহজালাল মাজার প্রাঙ্গণে এখন বাজে -“বেবি ডল মে সোনে দি” । যুবক যুবতিদের প্রেমের বাতাসে এখন বামপন্থার হাওয়া বইছে । প্রথম দেখা,ভাললাগা অতঃপর শুয়ে পড়া । প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক বৈধতার ধার ধারেনা একালের যুবক যুবতিরা ।
স্বদেশী আমলেও দেখা গেছে বাবা ইংরেজদের খয়ের খাঁ অথচ ছেলে বিদ্রোহী বিপ্লবী। বাবা ইংরেজদের পা টিপে দিচ্ছে আর ছেলে পেছন থেকে কামানের গোলা ছুড়ে মেরে পা উড়িয়ে দিচ্ছে ।
একালেও তাই পরিবারের প্রথম পুরুষ এসটাবলিশমেন্টের দাস , দ্বিতীয় পুরুষ বিদ্রোহী বাম । ক্রোধ হল বামপন্থা , আর যতযাই বলুক আজ আমরা সবাই বামপন্থী !!
বামপন্থের এই নিদারুন সংজ্ঞা
বামপন্থের এই নিদারুন সংজ্ঞা মাথায় ঢুকেও যেন ঢুকলো না!