পরিবার কর্তৃক ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়, ছেলেমেয়েদের নৈতিক ভিত্তি অর্জনের জন্য। অন্তত মা -বাবারা তাই মনে করেন। শেখানো হয় নিজ ধর্মের প্রতি সর্বদা অনুগত এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল থাকতে। কিন্তু ‘আমার ধর্মই সেরা, তবে সব ধর্মই সমান ‘এই পরস্পরবিরোধী ধারণা নিয়ে আমরা বড় হয়ে উঠতে থাকি। নিজের ধর্ম যখন অন্য সকল ধর্ম অপেক্ষা বড় মনে করা হয়, তখনই সাম্প্রদায়িকতার ক্ষুদ্র বীজটি অজান্তেই রোপিত হয়। হ্যাঁ, অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে আমাদের চলাফেরা, ঘোরাফেরা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সবই বজায় থাকে। তবে মনের গভীরে স্বীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ঠিকই বদ্ধমূল রয়ে যায়। ধর্মীয় অনুশাসন আমরা খুবই কম পালন করি, কারণ বাস্তব জীবনে তার উপযোগ নেই। শুক্রবার নিয়ম করে মসজিদে যাওয়া, পরীক্ষার আগে মিলাদ দিয়ে আত্নীয় স্বজনদের কাছে দোয়া চাওয়া, ক্ষণিকের জন্য পরকালের শাস্তির ভয়ে আঁতকে ওঠা। ঈমানের মূল যে ভিত্তি কালেমা, সেই চার কালেমা প্রায় সবাই ভুলে যাই। কারণ, ইহলৌকিক জীবনে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আমাদের পালন করতে হয় স্রেফ পরকালের ভয়ে। আমরা আমাদের এই প্রত্যক্ষ জীবন যা চেতনা দিয়ে অনুভব করি, তার মায়ায় আবদ্ধ। সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তিটিও মৃত্যুর ভয়ে ভীত। যদিও সে আশাবাদী সুখী পরকাল লাভে, কিন্তু পৃথিবীর আলো হাওয়া অধিক সুখের। মুখে স্বীকার না করলেও, তা মনের চেতনে কিংবা অবচেতনে থেকে যায়। ধর্ম বিশ্বাস তা ফলদায়ক হোক বা না হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অক্ষতিকর। কিন্তু যখনই তা আমাদের ইহলৌকিক, বস্তুগত জীবনকে নিয়ন্ত্রনের উদ্যোগ নেয়, এবং জাগতিক জীবনে প্রবল শক্তিমত্তা নিয়ে হাজির হয় তখনই সৃষ্টি হয় নানা অনর্থের। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এই সময়ে আমাদের জীবনযাত্রার ধরণ এবং মান পরিবর্তিত হচ্ছে অতি দ্রুত। জীবনের স্বার্থে, জীবনকে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং অর্হবহ করতে আমরা পুরনো সামাজিক রীতিনীতি, অর্থহীন অমানবিক প্রথা থেকে নিজেদের বের করে আনি। আমাদের এই জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী অন্যতম উপাদান হল ধর্ম। ধর্ম আমাদের কিছু রীতিনীতি দিয়েছে পালন করতে যেগুলোর দ্বারা আমাদের পরকালের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে বলা হয়। এসব রীতিনীতি, অনুশাসন একই সাথে অপরিবর্তনীয়। হঠাৎ করেই জীবনের প্রয়োজনে আমরা ধর্মীয় রীতির উর্ধ্বে চলে যেতে পারি না, পরিবার সমাজ রাষ্ট্র এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রনের ভার নেয়। পাশাপাশি জাগতিক জীবনের সাথে সঙ্গতিহীন ধর্মীয় বিধিনিষেধ আঁকড়ে ধরেও থাকতে পারি না। আত্নপরিচয়ের সংকটে আমরা জর্জরিত হই। তবে সময় এসেছে ধর্মবিশ্বাসীদের নিজেদের ধর্মকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার। মনের এক কোণে আমরা যে স্বীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা লালন করি, তার পরিবর্তন ঘটানোর। বিবর্তনের এক পর্যায়ে নিয়ানডার্থাল মানুষেরা সর্বপ্রথম আত্নার ধারণা নিয়ে এসেছিল। নিশ্চয়ই ধর্ম একদা মানুষের বাঁচার ক্ষেত্রে বাড়তি উপযোগ এনেছিল বলেই এর সৃষ্টি। তবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বাধীন সত্তার সম্পূর্ণ বিকাশে, সম্প্রদায়বিহীন অভিন্ন সমাজের জন্য ধর্মকে কাঠগড়ায় দাড় করাতে হবে।