রাত নিস্তব্ধ!! পুরোটা শহর গভীর নিদ্রায়।। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে কুকুরের ওউ…. ডাক।। সমগ্র দেশে কার্ফিউ চলছে।। যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।। হঠাৎ গুলির শব্দ আর মানুষের আত্মচিৎকারের ধ্বনি আকাশ-বাতাস ভারি করে তোলতে লাগল।। শুরু হয়ে গেছে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানের অসহায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর হত্যাযজ্ঞ।। ইতিহাস সেই রাতের নাম দিল ‘অপারেশন সার্চলাইট”, বাঙ্গালীর জীবনে দাগ কেটে গেল একটি তারিখ ২৫শে মার্চ।।
ইতিহাসঃ
রাত নিস্তব্ধ!! পুরোটা শহর গভীর নিদ্রায়।। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে কুকুরের ওউ…. ডাক।। সমগ্র দেশে কার্ফিউ চলছে।। যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।। হঠাৎ গুলির শব্দ আর মানুষের আত্মচিৎকারের ধ্বনি আকাশ-বাতাস ভারি করে তোলতে লাগল।। শুরু হয়ে গেছে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানের অসহায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর হত্যাযজ্ঞ।। ইতিহাস সেই রাতের নাম দিল ‘অপারেশন সার্চলাইট”, বাঙ্গালীর জীবনে দাগ কেটে গেল একটি তারিখ ২৫শে মার্চ।।
ইতিহাসঃ
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় লাভ।। বাঙালিরা আশা করেছিল যে ক্ষমতার। পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ৬ দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে।। ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ এ তৎকালীণ রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খান
পিপিপি ( পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি ) এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে জাতীয় বিধানসভার কার্যাবলি মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন।। পিপিপি এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলো, জুলফিকার আলি ভুট্টো এও বলেন যে তিনি বাঙালিদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চান।। এই স্থগিতকরণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ ১৯৭১ এ একটি গণসমাবেশের আয়োজন করে।। এই সমাবেশ এতই সফল ছিল যে পাকিস্তান সরকার সেনাছাউনি ও পূর্বপাকিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যাবলী সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়।।
সধারন জনগণ ও সেনাবাহিনী এবং বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যাকার সংঘর্ষ ছিল প্রতিদিনকার সাধারণ ব্যপার।। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকের উদ্দেশ্যে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা আসেন,এবং এরপর ভূট্টো তার সাথে যোগ দেন।। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা না হস্তান্তরের উদ্দেশ্য পাকিস্তানী জেনারেলরা,( যাদের মধ্যে গুল হাসান ছিলেন অগ্রগামী) পিপিপি কে সমর্থন যোগাতে থাকে যার ফলাফল দাঁড়ায় সেনা আক্রমণ।।
অপারেশনের পরিকল্পনাঃ
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন।। পাকিস্তানের উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের
জিওসি লে জেনারেল সাহেব জাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের পূর্বেই তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।। লে জেনারেল টিক্কা খান কে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়।।
পরিকল্পনার প্রধান গৃহিত সিদ্ধান্ত সমূহ ছিল,
১. সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করতে হবে।।
২. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে।।
৩. ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে।।
৪. সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।।
৫. টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।।
৬. সকল পূর্বপাকিস্তানী (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে।।
৭. আওয়ামী লীগের মনে ভূল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন।। এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্থাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন।।
মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর নিম্ন লিখিত লক্ষ্য ছিলঃ
১. রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন/
টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া।।
২. ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌ-পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে টহল জারি করা।।
৩. অপারেশন চলাকালীণ সময়ের মধ্যে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের আরো ১৫ জন বড় নেতাদের গ্রেফতার করা।।
৪. ধানমন্ডি এলাকায় এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্চ (খোঁজ) করা।।
৫.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দফতর, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইবিআর কে নিরস্ত্র করা।।
৬. গাজিপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রগুদাম দখল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।।
আবার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি কর্তৃক প্রণীত ঢাকা আক্রমণের পাকিস্তানী পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপঃ
১. ১৩তম সীমান্তবর্তি সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা প্রদান করবে।।
২. ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে।।
৩. ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র
করবে এবং ইপিআর সদর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে।।
৪. ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিস্ক্রিয় করবে।।
৫. ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান
ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।।
৬. ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরের
নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।।
৭. 3 SSG এর একটি প্লাটুন মুজিবকে ধরার দায়িত্বে ছিল।।
৮. ২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহীদের নিস্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিল।।
৯. ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।।
অপারেশন সার্চলাইটঃ
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ সকালের সময়ে পিলখানার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিল তখন বাঙালি ইপিআর অফিসারদের পাকিস্তানী অফিসাররা পিলখানায় ব্যস্ত রেখেছিল এবং সৈন্যদের প্রায় সবাইকে কাজ বন্ধ রেখে বিশ্রামে পাঠানো হয়।। সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পরে যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে এবং তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধক বসানো শুরু করে, কিন্তু এই সব প্রতিবন্ধক পাকিস্তানী সৈন্যদের চলাচলে কোন তাৎপর্যপূর্ন বাধার সৃষ্টি করতে পারে নি।। যেসব স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় প্রতিবন্ধক স্থাপন করছিল তারাই পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়।। যদিও অপারেশন রাত ১১টায় শুরু হবার কথা, পাকিস্তানী সৈন্যরা ১১.৩০এ ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয় কারণ পাকিস্তানী ফিল্ড কমান্ডার চাইছিলেন যে বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া করার কোন সুযোগ না পায়।। সেনা বাহিনীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল।।
পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সাথে ঢাকা শহরের সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।। মেজর বেলাল এবং লে.কর্নেল জেড এ খানের সাথে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতেই সহজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরতে সক্ষম হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ
বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা কৌশলে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন এবং ২৯ মার্চের ভেতর শহর ত্যাগ করেন।। ১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা প্রদানের চেষ্টাকে পরাভূত করে, ছাত্রনিবাসে অবস্থানরত নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, সাথে বেশ কিছু অধ্যাপকদেরও হত্যা করে এবং তারপর ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণের জন্য গমন করে।। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশেরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পরাজিত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পরে অথবা এদিক সেদিক পালিয়ে যায়।। পাকিস্তানী সেনারা অপারেশনের সময় জনগণের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে যথেচ্ছ ভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে।।
ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপি কারফিউ জারি করা হয়।। বেঁচে যাওয়া পুলিশ এবং ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ
বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় জমায়িত হয়।। ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত অনিয়মিত আক্রমণ চলতে থাকে, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার
করতে না পারা ছাড়া সার্বিক অপারেশনের অন্যান্য সব লক্ষ্য অর্জিত হয়।। এছাড়া পাকিস্তানী সেনারা শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপল কার্যালয় এবং রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করে দেয়, যাদের একটিরও কোন প্রকার সামরিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না।।
২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রির
২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রির ঘটনাবলী নিয়ে চমৎকার গোছান একটি পোস্ট। যদিও লেখায় সেই ভয়াল রাতের ভয়াবহতা কিছুতেই বুঝানো সম্ভব না, তবু ইতিহাস বারবার পাঠের মাধ্যমে দেশের প্রতি দায় বোধ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।
অসাধারণ পোষ্ট ।
অসাধারণ পোষ্ট ।
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ