নারী দিবস শব্দের দিবসকে পাশে রেখে শুধু নারীকে সামনে এনে কিছু বলি আগে। আমার মতে বাইয়লজিকালি নারীরা একটু পরিহাসের শিকার। শুধু মাত্র সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা থাকার কারনে নারীকে জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় একটা হ্যাপা সামলাতে হয়। তারপর সন্তান জন্মদানের সময় সহ্য করে যে সন্তান জন্ম দেয় এইজন্য নারীদের কাছে সমাজ-সভ্যতা যতটুকু কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তা পর্যাপ্ত না। পুরুষদের যদি এসব জটিলটা পোহাতে হতো তাইলে নির্ঘাত সমাজের ঘাড়ে চড়ে বসতো।শুধু শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কারনে পুরুষের যে দম্ভ তাতে এটা ভাবা অন্যায় না। এত হ্যাপা সামলেও নারী তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পায়না। পায় শুধু করুনা, সহানুভুতি। নারীকে ঘরে বসে থাকতে বলা হয়। নিজের লাম্পট্যের দায় নারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের নারীরা অনেক কষ্টে বাড়ি ছেড়ে বাইরে এসেছে। অনেকের তো সম্মান-ইজ্জত নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। প্রস্তুত থাকতে হয় অপরিচিত কোন হাতের মৃদু চাপের কিংবা লজ্জাস্কর কোন অশ্লীল মন্তব্যের। এসব হয় একদম ভরা মজলিসে,রাস্তায়।কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদ করে, কারো হয়তো লজ্জায় মুখে কথাই আসেনা, কারও বা এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। মনে মনে অভিশাপ দিয়ে তারা সরে পড়েন। মজার ব্যাপার নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ঢাকা শহরের পাবলিক বাস গুলোতে। সমাজের কাছে নারী যে কতটা বোঝা সেটা সেখানে একদম পরিস্কার। প্রায়ই বাসগুলোতে লেখা থাকে “মহিলা, শিশু এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য সংরক্ষিত আসন”। আসন গুলোরও বেশ অবস্থা, বাসের সবচেয়ে বিপদজনক স্থানে-ইঞ্জিনের উপরে, “ফ্রন্ট গ্লাসের” একদম কাছে। গাড়ি যদি দুর্ঘটনায় পড়ে সবার আগে মরবে সেখানে বসা নারীরা। তাছাড়া বাসে উঠতে নামতে হেল্পারের “উষ্ণ অভ্যর্থনা” তো আছেই। সেদিন দেখলাম এক মহিলার আসতে দেরি হওয়ায় তাকে না নামিয়েই বাস ছেড়ে দেওয়া হলো। মহিলা কী করবে? হাতে তার দু মাসের বাচ্চা আরেকটা ব্যাগ। বেচারি অনেক অনুনয় বিনয় করে বাস থামাল। সাথে কিছু কথাও শুনল তার সহযাত্রীদের,” মাইয়া মানুষ এত স্লো!”, “থাক ড্রাইভার সাব, মাইয়া মানুষ। নামায় দেন”। এই সমাজই তাকে বাচ্চা লালন পালনের ভার দিয়ে ধীর করে দেয়। আবার এই সমাজই তাকে “ধীর কেন”? বলে প্রশ্ন করে! কি বিচিত্র এ সমাজ আর এ সমাজের মানুষ। ঢাকা শহরে একজন নারীকে যে কী যুদ্ধ করে বাসে চড়তে হয় সেটা ভুক্তভুগি নারীই বলতে পারবেন। পুরুষের রোষ সামলে নারীকে সারা জীবন যুদ্ধ করে কাটাতে হয়।সেটা বাসের পরপুরুষ হোক কিংবা আপন গৃহের স্বামী।
অনেক তো নারী নিয়ে বললাম এখন একটু দিবস নিয়ে বলি। বাংলাদেশ বাজার হিসেবে এখনও সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। দিবস টিবসের ব্যবসা তাই এখনও সেভাবে জমে ওঠেনি । উৎসব প্রিয় বাঙালি এখনও তার নির্দিষ্ট কিছু উৎসবেই তার আনন্দ খুঁজে ফেরে। যদিও কর্পোরেট সংস্কৃতি যতই ঘাটি গাড়ছে ততই এসব দিবস হালে পানি পাচ্ছে। “ভ্যালেন্টাইন্স ডে” এর উৎকৃষ্ট উদাহরন। “ভালোবাসা দিবসের” নামে মানুষ স্বৈরাচার পতন দিবসের শহীদদের ভুলতে বসেছে। তাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হলে শত শত কোটি টাকার গিফট কিনবে কে? আমি কিন্তু “মে দিবসকে” এই কাতারে ফেলছি না। তবে নারী দিবস নিয়ে আমার কিছু কথা আছে।
বর্তমান যে নারী দিবস আমরা যা দেখি এটা আসলে কর্পোরেট বেনিয়াদের দ্বারা হাইজাককৃত। নয়তো “আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক দিবস” থেকে শ্রমিক কথাটি এভাবে হারিয়ে যাবে কেন? হারিয়ে যাবে কেন এর উৎপত্তির ইতিহাস। ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ রাশিয়ায় শ্রমজীবী নারীরা “ রুটি ও শান্তির” দাবিতে হরতাল ডাকে। এই হরতাল ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। পরদিন নারী টেক্সটাইল শ্রমিকরাও হরতাল আহবান করে যা পড়ে সর্বাত্মক হরতালে রূপ ন্যায়। অথচ আজ এসব ইতিহাসের কোন জিকির নেই। “নারী দিবস” হয়ে গেছে গিফট দেওয়ার উপলক্ষ। হাই হিল পরে পার্টিতে মদ গেলার উপলক্ষ। যে নারী সারাদিন ঘেমে নেয়ে তার সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য অভিযোগ খোঁজে না, বাসায় বাসায় কাজ করে স্বামী পরিত্যক্তা যে নারী তার সন্তানের জন্য রক্ত পানি করে যায়, সারারাত ওভারটাইম করে যে নারীকে কলঙ্কের গ্লানি বইতে হয় সেই নারীকে সম্মান জানানোর একটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম হতে পারত এ নারী দিবস। কিন্তু তা আজ শুধু হাই হিল ফেমিনিস্টদের দিবস হয়ে গেছে। যেখানে নারী শুধু “এ পিস অব ফ্লেশ উইথ কার্ভস”!
এমনিতে লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। শেষ করতে চাই ছোট একটা খবর জানিয়ে। গতকাল নারী দিবসের প্রাক্কালে দুপুর বারোটায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে এক আদিবাসী নারী ধর্ষিত হয়েছেন। জনতা ধর্ষকদের ধরিয়ে দিলেও পুলিশ তা টাকা পয়সা দিয়ে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ । এই নিয়ে গত ২ মাসে ৪ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। যার মধ্যে একজনকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে। মেইন্সট্রিম মিডিয়াতে এসব খবর খুব একটা আসেনা। যাই খবর আসে তা কিছু পাহাড়ি সংগঠনের সীমিত তৎপরতার কারনে। সমতলেও নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে। যার অধিকাংশ বিচার হয়না। থার্ড ডিগ্রি বার্ণ সহ্য করে যে নারী শতাব্দির পর শতাব্দি এ মানব জাতির বিলুপ্তি রোধ করেছে তার প্রতি পুরুষের এই অপমানটুকু না করলেই কি নয়?
এই সমাজই তাকে বাচ্চা লালন
চরম বাস্তবতা ।