“একজীবনে রবীন্দ্রনাথ”
“ অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেন
তার বক্ষে বেদনা অপার
তার নিত্য জাগরণ অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে
অহরাত্রি দগ্ধ করে প্রাণ” ।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরচিত এই পঙতিমালা যথার্থ ভাবে কবিগুরুর কর্মময় জীবনের স্বরূপ ফুটিয়ে তোলে। যে কবি তার জীবদ্দশায়ই নিশ্চিত ছিলেন তার রচিত কাব্য, গীতি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস তার মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও পাঠিত-পঠিত হবে, তার সৃষ্টকর্ম নিয়ে মন্তব্য করতে যাওয়া আমার মত অভাজনের জন্য অন্যায়। তবে আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে রবীন্দ্রনাথ যে রুপে এসে আমার কাছে ধরা দিয়েছেন, সাহিত্তের অপার সৌন্দর্যের সাথে হাতে ধরিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সে স্মৃতিচারন করা হয়ত ধৃষ্টতা হবে না।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, স্কুলে আর দশজন সহপাঠির সাথে গলা মিলিয়ে -“আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে” পড়া ই আমাকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টকর্মের সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জগতে তখনই বিরাট কোনও আলোড়ন সৃষ্টি না করলেও আজ এই বয়েসে এসে উপলব্ধি করি আর অবাক হই, সহজ সরল বিষয়গুলোকে সহজ সরল ভাষায় ফুটিয়ে তোলার কি আশ্চর্যজনক ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল তার! টি এস ইলিয়ট যতই বলুন – “ দুর্বোধ্যতাই আধুনিক কবিতার মূল উপজীব্য” অথবা রবীন্দ্রোত্তর কল্লোলযুগের কবিরা যতই দুরবদ্ধতাকে আঁকড়ে ধরে কবিতা লেখার চেষ্টা করুন না কেন, আমার কাছে রাবীন্দ্রিক ঢঙ্গের কবিতাই আজীবন প্রিয় থাকবে। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এসে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ আর সেভাবে কিনে পড়ার সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু কলেজ জীবনে কিনে পড়া বলাকা কাব্যগ্রন্থ মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে শব্দের গাঁথুনিতে সার্বজনীন গতিময়তার সাথে তাল মেলানোর ব্যার্থ প্রয়াস বা বইয়ের তাকে রাখা গীতবিতান খুলে সময়ে অসময়ে গুনগুন করে ওঠা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস।
সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি তার ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে। এডগার এলেন পো, বা সমারসেট মম যে কাজটা ইংলিশ শর্ট ফিকশনের জন্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তা করেছেন আমাদের বাংলা ভাষার ছোট গল্পের জন্য। তিনি স্বহস্তে বাংলা ছোট গল্পের গাঁথুনি তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পুরোটাই আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাই আলাদা আর কোনও গল্পের নাম উল্লেখ করে তার ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। কারন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের উপর অসংখ্য বই ইতোমধ্যে লেখাও হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের হাতে তৈরি শিষ্য প্রমথনাথ বিশী “রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প” বইটি এক্ষেত্রে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তবে তার ছোটগল্পের যে দিকটি নিয়ে আমার গর্ববোধ হয় তা হচ্ছে, এগুলির অধিকাংশই আমাদের বাংলাদেশের পটভূমিতে লেখা। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে জমিদারির কাজ দেখার ফাঁকে ফাঁকে পদ্মার বুকে বজরায় ভেসে ভেসে লিখেছেন বেশকিছু গল্প।
আমার জীবনের বেশ কিছু অমার্জনীয় অপরাধের একটি হল, “গোরা” ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আর কোনও উপন্যাস আমার পড়া হয়নি। সে নাই হল, কিন্তু এক “গোরা” পড়েই শত সহস্র কুর্নিশ জানিয়েছি কবিগুরুকে। চৈতন্য প্রবাহ রীতিতে প্রথম উপন্যাস লেখেন বোধ করি সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, তবে গোরায় রবীন্দ্রনাথ তার মুখ্য চরিত্রের যে মানসিক বা নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা সেই যুগের যেকোনো বাঙালি লেখকের জন্য অভূতপূর্ব।
প্রবন্ধ রচনায় অনন্য রবীন্দ্রনাথের মেঘদুত, নববর্ষা, শিক্ষার বাহন, সাহিত্য তত্ত্ব বা সভ্যতার সঙ্কট ইত্যাদি লেখা আমার পড়তে হয়েছে মনের টানে। প্রবন্ধ রচনায় রবীন্দ্রনাথের ভাষার কাঠিন্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে। তবে John Henry Cardinal Newman এর লেখা The Idea of a University এর ধারাবাহিকতায় পড়া শিক্ষার বাহন প্রবন্ধটি আমার শিক্ষা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমি পড়াশোনার আরও গঠনমূলক-গবেষণামূলক ও নিরীক্ষাধর্মী দিকগুলোতে আগ্রহী হই।
সম্প্রতি প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম, সাহিত্য চর্চার এতগুলো দিন পার করে এসে রবীন্দ্রনাথে তার আর সেই যৌবনের দিনগুলির মুগ্ধতা নেই। সুনীল বড় সাহিত্যিক ছিলেন, তিনি এ কথা বলতেই পারেন। তবে আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ এসে ধরা দিন নিত্য নতুন রুপে, প্রত্যহ, এই আকাঙ্খা আমার থাকবে আজীবন।