প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা-১
প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা-১
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের ধারাবাহিকতায় প্রতিটি স্তরেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। এই স্বাদ রস গন্ধ আমরা কতটুকু নিতে পারি সেটাইতো জীবনের সবার্থকতা হওয়া উচিত। বাল্যকালের সেই চিত্ত চপলতার, অবুঝ উদ্দাম দূরন্তমনা, এটি একটি ভিন্ন স্বাদ, যা মনকে আজও পুলকিত করে। যৌবনের উদ্দাম প্রেম, ভাললাগার যে তীব্রতা, রাত জেগে গল্পের আসরে মেতে থাকা, বন্ধু বান্ধব মিলে বেড়িয়ে পড়া, প্রকৃতির সংগে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, এই স্বাদ কে পায় নি? এটিও জীবনের রোমান্সকর অভিজ্ঞতা। মধ্য বয়াসে রয়েছে আরও এক ভিন্ন স্বাদ যা জীবনের পুর্ণতা আনে। ছেলে মেয়ে ঘর সংসারের মধ্যে এটি একাকার হয়ে যায় কখনো। টাকা পয়সা জীবন ধারনের জন্য খুবই প্রয়োজন। তবে জীবন যাপনের জন্য যেটি বেশী প্রয়োজন সেটি হল art of life. জীবনের সৌখিনতাকে যৌবনে এসেই যদি হারিয়ে ফেলি, ফলে সংসার জীবনে স্থবিরতাই নেমে আসে। প্রতিটি জীবনের একটা নিজস্ব ধরন রয়েছে যেটা তার স্টাইল। সংসারে এসে অনেকেই সেই অর্জিত স্টাইলকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে প্রবাসের বহু সুযোগ সুবিধা থাকা সত্তেও তা গ্রহন করতে ব্যর্থ। এর সংখ্যা নিহাত কম নয়। আমার পরিচিত নব্বই বছরের এক বিদেশী বৃদ্ধার জীবন যাপনের স্টাইল আমাকে এতই মুগ্ধ করেছিল যা আমাকে আজও আন্দলিত করে। আজ সেই গল্পই শুনাতে চাই।
বয়স নব্বই ছুই ছুই। দুই চোখ তার একেবারেই অন্ধ। তবে কান দুটো তার সদা জাগ্রত জ্বল জ্বল চোখের মতই। পিন পত্তনের শব্দটি পর্যন্ত তার দৃষ্টির বাইরে যেতে পারে না এই অন্ধ চোখ এড়িয়ে। তাই অন্ধত্ব তার বিড়ম্বনা না বাড়িয়ে বরং অন্যান অংগের সজীবতাই বৃদ্ধি করেছে। আমার আগমনে ইহুদী এই বিধবা মহিলাটি এমন একটা খিল খিল করে হাসি দিতেন যেন তার মত সুখী আর কেহ নেই। স্বামীর দেওয়া ডায়মন্ডের আংটি সযত্নে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন সেটি আমাকে দেখাতেন, এবং জানাতেন বাড়িতে তার সেই ভাতিজা এসেছিল যে তার সম্পত্তির লোভে নাকি প্রায় আসে। এটি ছিল তার এক ধরনের সন্দেহের বাতিক। আসা মাত্রই তিনি আমাকে কয়েকটি অভিযোগ শুনাতেন। তার একটি হল ভাতিজা্র লোভ বাড়িটির উপর। টরন্টতে অভিজাত এলাকায় তার বাড়ি। ছেলে মেয়ে না থাকায় তিনি বাড়িটি উইল করে দিয়েছেন কোন একটা কল্যান মুলক প্রতিষ্ঠানকে। এটি তিনি করেছেন প্রায় দশ বছর আগে। সেটি তিনি প্রায় ভুলে যান। স্মরণে তিনি শান্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় হিটলারের ভয়ে কি ভাবে ইউরোপ থেকে পালিয়ে এখানে এসে স্থায়ী বসতি করলেন সেই কাহিনী গড় গড় করে বলে যেতেন। তখন তার বয়স ১২ বছর। পিতা মাতার সংগে দুভাই বোন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাটিয়ে ছিলেন প্রায় দুতিন বছর। ক্যাম্পের কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় অপমানে তার মুখ লাল হয়ে যেত। তার পরিবারটি হিটলারের নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ছিল কি না তা পরিস্কার না হলেও ক্যাম্পে থাকা মানে বিরাট অসম্মান জনক একটি মেয়ের জন্য তা তার মুখেই প্রকাশ পেত। কানাডায় ইহুদীরা অনেক ধনী ও জ্ঞানী। জ্ঞান আর ধন এই দুটি তারা সব সময় আকড়িয়ে রেখেছে। ইউরোপ থেকে তাড়া খেয়ে যখন তারা কানাডায় আমেরিকায় পাড়ি দেয় তখন তারা ছিল নিঃস্ব। কিন্তু তাদের ছিল বেচে থাকার উদ্দাম ইচ্ছা। এই ইচ্ছা শক্তিই বলেই জ্ঞান ও ধন এ দুটিই অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। টরোন্ট শহরের খুব নাম করা বড় ধনী পরিবারের একটি হলো ‘মারভিস ফ্যামেলি’। এটিও এক ইহুদী ব্যবসায়ী। টরোন্টর থিয়েটার ব্যবসার মালিক এই পরিবারটি। টরোন্টর এই বিখ্যাত পরিবারে মধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে কাহিনী আরেক দিন শুনাব।
কানাডায় আমাদের দেশের মত কোন উত্তরাধিকার আইন নেই। অর্থাত পিতা মাতার সম্পত্তির উপর সন্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে উইল করতে হবে। এই আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া সম্পত্তির উপর সন্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সম্পত্তি দান করেন বিভিন্ন সমাজ কল্যান মুলক প্রতিষ্ঠানকে। Donation বা দান করা এখানকার একটি সংস্কৃতি। যার ফলে সরকার ও কল্যান মুলক প্রতিষ্ঠান গুলো এত ধনী। আমরাও দান করি, তবে তা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, যেখানে পরকাল চর্চার কাজেই তা ব্যয় হয়।
অন্ধদের জন্য টরোন্ট লাইব্রেরিগুলোতে বিশেষ প্রোগ্রাম রয়েছে। যে সব অন্ধ লোক, কোন কিছু পড়তে চান, তাদের জন্য CD আকারে বই পাওয়া যায়। আমার পরিচিত এই বৃদ্ধার অবসর সময়ের সাথি হলো CD আকারে বিভিন্ন বইপত্র। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও জীবনটা তার বড়ই আনন্দময়। অন্ধত্ব তার আনন্দকে বিন্দু মাত্র খন্ডন করতে পারেনি। কারন তার রয়েছে নিশ্চিত ভবিষ্যত। আমাদের দেশে হলে এই ধনী অন্ধ বুড়ির জীবন নব্বই বছরের জায়গায় নয় দিনেই নিঃশেষ হয়ে যেত। এতে কোন সন্দেহ নাই। এই বৃদ্ধার কাছে আসলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। মাত্র ৭৫ বছর বয়সে হাড্ডি ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায়। অনেক কষ্ট করে গত বছর গিয়ে হজ্জ করেছেন। তার এখন একটি মাত্রই চিন্তা মৃত্যুর পর কি হবে। এই মৃত্যুর চিন্তাই তাকে আরও অসুস্থ্য করে দিচ্ছে দিনে দিনে। যে জগত সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনা নাই তা নিয়ে চিন্তা করে নিজেকে কেন আমি আরও অসুস্থ্য করবো, এটি আমার বধগম্য না। জীবন তো আনন্দময়। এদেহে যে অবস্থায় যত সময় পর্যন্ত প্রাণ আছে, ততো সময়ই আনন্দময় করতে পারাই জীবনের একটি বড় পাওয়া। মৃত্যুর চেয়ে জীবনের দাবী তো অনেক বেশী। সেখানে মৃত্যুর চিন্তা কেন জীবনের সকল দাবীকে নিচিহ্ন করে দেবে? নব্বই বছরের এই বৃদ্ধা, যার চোখ দুটি অন্ধ, মৃত্যুর জন্য তার মধ্যে কোনই হাহাকার নাই। নেই কোন সংস্কার, নেই কোন ধর্মীয় ভয় ভীতি। আছে শুধুই এক আত্ততৃপ্তি, তা হলো বেচে থাকা্র আত্ততৃপ্তি। আজও সে জীবনের স্বাদ রস গন্ধ উপভোগ করছে ঠিক যৌবনের মতই। আজও একটি কবিতা, একটা উপন্যাস তাকে আন্দোলিত করে। মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি একটা ভাল কাজে ব্যয় হবে এটি ভেবে সে তৃপ্তি পায়। সংসারে ছেলে মেয়ে না থাকার কোন অতৃপ্তি নাই তার মধ্যে। তার একটাই অভিযোগ ভাতিজা কেন তাকে দেখতে আসে।
আমরা কথায় কথায় বলি- ওদেরই তো দিন। ছেলে মেয়ে একটু বড় হলেই পিতা মাতাকে অহরহ এই কথা বলতে শুনা যায়। তাহলে ছেলে মেয়েই সব? পিতা মাতার নিজস্ব কি কিছুই নেই? ছেলে মেয়ে অবশ্যই গুরুত্বপুর্ণ তবে নিজের সব কিছু বাদ দিয়ে কেন হবে? আমার পরিচিত অনেক বান্ধবী যারা শিক্ষা জীবনে অনেক কিছুর চর্চা করতো তারা সেই গুলোর অনেক কিছুই ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তিতে। যে খুব উপন্যাস পড়তে ভালোবাসতো তাকে এখন বই গিফট দিলে সেই বইয়ের একটা পাতা পড়লে নাকি মাথা ধরে। একটা ছোটগল্পের শিল্প সাহিত্যের উতকর্ষের কথা না হয় বাদই দিলাম। তাহলে আমাদের উপভোগ্য কি আর রহিল? বস্তুতে সামান্য উপভোগ থাকতে পারে তবে এটা সাময়িক। পরবর্তিতে এটি ব্যাধিতে রুপ নিতে পারে যা পরিবেশ দুষনে অবদান রাখবে এবং এটি হচ্ছেও। এখানকার ছেলে মেয়েরা ব্রান্ডের প্রতি এমন ভাবে ঝুকে পড়েছে যে মলে গেলেই কম পক্ষে দুশ ডলার পকেট থেকে বের হবেই। অথচ আমি অনেক ধনী কানাডিয়ান কে দেখেছি ‘ভ্যলু ভিলেজ’ থেকে জিনিস কিনতে। এটি পুরানো জিনিসের দোকান ২/১ ডলারে জিনিস পাওয়া যায়। এত টাকার মালিক হয়েও পুরান জিনিস ব্যবহার করে কেন জানেন? টাকা জমিয়ে দান করে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা হাসপাতালে। আবার ক্রিসমাসে সময় সেই আবার দামী দোকান থেকে অনেক খেলনা ড্রেস কিনে সেই ভ্যালু ভিলাজেই দান করে। এটি করে যাতে যারা নতুন জিনিস কিনতে পারে না তারা যেন এই সময় নতূন জিনিস পায় এখানে এসেই। এটি আমি দেখেছি ছোট শহর গুলতে অনেক বেশী। দুঃখের বিষয় হলো আমি নিজেই এটি করতে ব্যর্থ। কারন মেয়েটি ব্রান্ড চিনে ফেলেছে স্কুল থেকেই। আর ব্রান্ডের ছড়াছড়িতো কমুনিটিতেই বেশী।
আমরা যেখানেই থাকি না কেন
আমরা যেখানেই থাকি না কেন ফুটানিতে ব্যস্ত। তা নিজ দেশেই হোক অথবা প্রবাসে॥
ভাল লাগল
ভাল লাগল