বর্তমান সরকার মেয়াদের শেষ প্রান্তে আছে। চার বছর প্রায় শেষ। দীর্ঘ এই সময়ে সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, যত বিরোধিতাই আসুক কিছু সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে আসেনি। যা করতে চেয়েছে যে কোনোভাবে তা সম্পন্ন করেছে। আরো লক্ষণীয় অন্য সব ক্ষেত্রে সরকার পূর্ববর্তী সরকারের বিরোধিতা করলেও কয়লা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। কী সেই মহামন্ত্র, যা এই একটি প্রশ্নে দুই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে এক করতে পেরেছে? আসলে তারা বহুজাতিক কোম্পানির দেখিয়ে দেয়া পথে হাঁটছে। তাই জ্বালানি খাতে তাদের নিজস্ব কোনো নীতি নেই। যখন যা কিছু বলা হয়, তা বহুজাতিক কোম্পানির ভাষণেরই ভিন্ন রূপ। এজন্যই এসব খাতে ব্যাপক জনবিরোধিতা সত্ত্বেও নির্লজ্জভাবে সব হাকিমই হুকুমে অটল থেকেছে।
উন্মুক্ত খননই পথ!
ফুলবাড়ী কয়লাখনি যেন বিশেষ এক পরিমাপক। বিদেশি বহুজাতিক, দেশের স্বার্থ, সাধারণ জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন- এ বিষয়গুলোতে সরকারের নীতি স্পষ্ট হয় ফুলবাড়ীতে গেলেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত জোট সরকার বহুজাতিকের পক্ষে রায় দিয়েছিল দেশের স্বার্থ ও গণমানুষের চাহিদাকে উপেক্ষা করেই। বর্তমান সরকারও বসে থাকেনি। মেয়াদের চার বছরে কয়লা নিয়ে সরকারের অসীম আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্য দিয়ে। তবে সেগুলো আগের ধারাবাহিকতা ছাড়া ভিন্ন কিছু না।
এই সরকারের ওপর চাপ ছিল জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার। তা সত্ত্বেও তারা বহুজাতিক কোম্পানিকে সেবা করার রাস্তা ছেড়ে আসতে পারেনি। আন্দোলনের চাপ সরকারকে শুধু কালক্ষেপণ ও ভিন্ন কৌশলের দিকে চালিত করেছে। তার নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারেনি। এজন্য উন্মুক্ত খনির সেই পুরনো সিদ্ধান্তটা নিতে সরকারের লেগেছে চার বছর সময় আর ১৫ সদস্যের রিভিউ কমিটির সত্যায়নপত্র।
রিভিউ কমিটি গঠনের সময়ই অভিযোগ উঠেছিল, জোর করে কারিগরিভাবে উন্মুক্ত খননের বিষয়টি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাতে পারে তারা। সরকারের ইঙ্গিতে কমিটি একটি যুৎসই প্রতিবেদন দেবে, যার ভিত্তিতে প্রণীত হবে কয়লানীতি। এমন মন্তব্যও করেছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অবশেষে সেই সম্ভাবনাকেই বাস্তবে রূপ দিল কমিটি।
সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, শর্ত সাপেক্ষে বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি উন্নয়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা আহরণই উত্তম পন্থা বলে কমিটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মত দিয়েছে। এতে সুপারিশ করা হয়েছে, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা ও ফুলবাড়ী প্রকল্পে ইতোমধ্যে সম্পাদিত সমীক্ষা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে তা নতুন করে করার।
এর মধ্য দিয়ে সরকারের কয়লানীতি স্পষ্ট হয়েছে। বেশ কিছুকাল যাবৎ সরকার একদিকে বলে আসছিল বিশেষজ্ঞদের মতামত ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করেই কয়লা উত্তোলন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু সংসদীয় কমিটি অব্যাহতভাবে উন্মুক্ত খনির পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। উন্মুক্ত খনির পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি। এই রিভিউ কমিটি তারই বৈধতা ঘোষণা করল। পাশাপাশি এই সরকার প্রমাণ দিল কয়লা প্রশ্নে আগের সরকারের মতো তারাও বিদেশিদের পক্ষে।
সরকার ও বিশেষজ্ঞ কমিটি, সবাই জানে উন্মুক্ত খনন কি ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনতে পারে। কমিটি নিজেই এ বছরের জানুয়ারিতে প্রস্তাবিত তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, উন্মুক্ত খনির ক্ষতি এত বেশি যে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে পানি দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় আনবে। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে কোথাও কোথাও হস্তচালিত নলকূপ কাজ করবে না। তা ছাড়া পানি সরবরাহের যে নেটওয়ার্ক আছে তা দূষিত হবার কারণে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ হবে। অববাহিকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরস্থ পানি দীর্ঘ মেয়াদের দূষণের শিকার হবে। প্রায় ১০ লাখ মানুষের পুনর্বাসন জটিলতা সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘর্ষের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি তৈরি করবে। ৩৮ বছর ধরে প্রতিদিন ৮০ কোটি লিটার ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহার করতে হবে। বৃষ্টির কারণে অনেক বর্জ্য পানিতে ধুয়ে যাবে এবং তা জমি, নদী, জলপ্রবাহ, নদীকে বিষাক্ত করবে।
কমিটি নিজেই বলেছে, ‘অতীতে এ বিষয়ে খুবই ভুল প্রচারণা চালানো হয়েছে যে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। ৯০ শতাংশ কয়লা মাটিতেই পড়ে থাকবে। এটা খুবই ভুল তথ্য। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিরও বিভিন্ন দিক আছে। রুম ও পিলার পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। যান্ত্রিক লং ওয়াল পদ্ধতিতে এটা ৭০ শতাংশে উঠতে পারে।’
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘এশিয়া এনার্জি বিনিয়োগ করবে ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু লাভ করবে কমপক্ষে ১ লাখ ৪২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। শুধু কৃষি আবাদের ক্ষতিতে ৫০ বছরের ক্ষতি হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।’
অভিমত দেয়া হয়েছে, ‘দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রয়্যালটির ভিত্তিতে কয়লা উত্তোলনে বিদেশি ঠিকাদারকে অনুমতি দান যৌক্তিক নয়। খনিজসম্পদ, তেল, গ্যাস ও কয়লার মালিক দেশের জনগণ। এসব ক্ষেত্রে রয়্যালটি গ্রহণ করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীর কয়লা ও গ্যাসের মালিকানা অনুমোদিত হবে যা তারা রপ্তানি করবে। এটা সংবিধানবিরোধী।’
অথচ সেই কমিটিই এখন বলছে, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এবং বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিই হবে সবদিক দিয়ে লাভজনক এবং যথোপযুক্ত। অর্থাৎ এতসব ভয়াবহ ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করার পরও আগের প্রতিবেদনের মতো এই প্রতিবেদনেও উন্মুক্ত খননের পক্ষেই মতপ্রকাশ করা হয়েছে।
কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ড. এজাজ হোসেনকে প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি গোড়া থেকেই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তেমন একটা যুক্ত নই। আমি প্রথমেই কাজকর্ম দেখে এর ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কারণ এই কমিটি নতুন কিছু করেনি। তারা সেই এশিয়া এনার্জির রিপোর্ট এবং অন্য কিছু কাগজপত্র দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে আরো ভালো স্টাডির যে সুপারিশ করেছিলেন এটাই তাদের করা উচিত ছিল। এখন তারা যে বলছেন, একটি পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত খনি চালনার কথা, এটা তো পাটোয়ারি কমিশনেই বলা হয়েছিল। কোনো কাজ হবে না বুঝেই আমি এখানে আর সময় ব্যয় করিনি। এজন্য আমি কমিটির কোনো সভায় যাইনি, কোনো কাগজপত্রেও স্বাক্ষর করিনি। তাছাড়া আমি যেহেতু আগে থেকেই উন্মুক্ত খননের পক্ষে কথা বলে আসছি, এজন্য যে পক্ষ এর বিরোধিতা করছে আমি কমিটিতে থাকলে তারা কমিটির প্রতিবেদনকে আমলে নেবে না ভেবেই আমি এখান থেকে দূরে থেকেছি। তবে কমিটি নতুন কিছুই করতে পারেনি। এজন্য তাদের পাঠানো প্রতিবেদনের কপিও আমি এখনো খুলে দেখিনি।’
রিভিউ কমিটির প্রধান প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা প্রধানত অর্থনৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়েছি। প্রতিবেদনে আমরা একতরফা উন্মুক্ত খননের কথা বলিনি। আমরা বলেছি, এটাকে বাতিল করে না দিতে। এই পদ্ধতিতে গেলে অর্থনৈতিক লাভ বেশি হবে।
কিন্তু এর আগে তো আপনারা বলেছিলেন, ‘এশিয়া এনার্জি বিনিয়োগ করবে ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু লাভ করবে কমপক্ষে ১ লাখ ৪২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। শুধু কৃষি আবাদের ক্ষতিতে ৫০ বছরের ক্ষতি হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।’
তাহলে কি দাঁড়াল? এই প্রশ্নের উত্তরে পেট্রোবাংলার সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘তা সত্ত্বেও অন্য সব পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতি লাভজনক বেশি। তবে আমরা এখানে এশিয়া এনার্জিকে কোনো অগ্রাধিকার দিচ্ছি না। প্রতিবেদন সরকারিভাবে প্রকাশ হলে তখন বিস্তারিত আলাপ করব। এখন এ বিষয়ে এর বেশি আলাপ করতে পারব না।’
রিভিউ কমিটির এই প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘এই কমিটিতে কারা আছে দেখলেই বোঝা যায়, এ কমিটি থেকে কি আসতে পারে। এখানে উন্মুক্ত খননের পক্ষের প্রবক্তারা সবাই আছেন। মোল্লা আমজাদের মতো চিহ্নিত এশিয়া এনার্জির দোসররা আছে এখানে। কমিটির অধিকাংশই সরকারি লোক। আর সরকার যে উন্মুক্ত খনন এবং কয়লা পাচারের জন্য বিদেশিদের চাপের মুখে আছে এটা কার না জানা। সুতরাং এ কমিটি কি সিদ্ধান্ত দেবে তা আগেই ঠিক হয়ে আছে। কয়লানীতি চূড়ান্ত করার প্রধান বাধা হচ্ছে, সরকার দেশের স্বার্থে আন্তরিক নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকাও এখানে উল্লেখযোগ্য। সাবেক রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ীর কয়লা উত্তোলনের জন্য যে চাপ দিয়েছেন, এবং জ্বালানি উপদেষ্টা যে সে অনুযায়ী কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা উইকিলিকসেই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিকভাবে যেভাবে এই প্রকল্পের পক্ষে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন তাতে এটা বোঝা যায় যে, তিনিও কোম্পানির লবিস্ট হিসেবেই কাজ করছেন।’
তার মতে, ‘রিভিউ কমিটির অনুসন্ধান সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ দেখতে গিয়েই রিভিউ কমিটির প্রতিবেদনের উপসংহারে উন্মুক্ত খননের পক্ষে মতামত রাখা হয়েছে। এটা সরকারের চাপেই, তাদের নিয়োগকৃত প্রতিনিধির দ্বারা করা হয়েছে। কারণ আমরা দেখছি, এশিয়া এনার্জিকে প্রতিষ্ঠার জন্য এখন সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাঠে নেমেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার যদি চাইত অনেক আগেই কয়লা সমস্যার সমাধান করতে পারত। ভারত সরকার আইন করে ১৯৭৩ সাল থেকে কয়লা উন্নয়ন ও উত্তোলন সম্বন্ধীয় সকল কার্যক্রম জাতীয়করণ করে এবং পাবলিক সেক্টর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে। ভারতের ৯৫ শতাংশ কয়লা পাবলিক সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং ৫ শতাংশ প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহ উত্তোলন করে। আমাদের পাশের দেশটি অনেক এগিয়ে গেছে। অথচ আমরা এখনো কমিটি আর মিটিংয়ের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশে যত কমিটিই করেন না কেন সেখানে বিদেশি তেল-গ্যাস ও কয়লা কোম্পানির স্বার্থ দেখার জন্য তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি থাকবেই। কয়লানীতি কমিটিতেও ছিল। আমার নেতৃত্বে এশিয়া এনার্জির প্রস্তাব মূল্যায়নের কমিটিতেও ছিল। বর্তমান কমিটিতেও আছে। এখান থেকে নতুন কিছু আশা করিনি। যা হওয়ার তাই হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, বদরূল ইমাম বলেন, ‘২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিপক্ষে ফুলবাড়ী জনগণের আন্দোলনে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সঙ্গে উন্মুক্ত খনন নিষিদ্ধ করার পক্ষে যে চুক্তি বিএনপি সরকার করেছে, তা বাস্তবায়ন না করার ফল হবে ভয়াবহ। কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমগুলোয় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, দেশের মজুদ কয়লা বর্তমানে ওঠানোর পরিবর্তে তা আগামী প্রজন্মের জন্য রাখা হবে। এসব দেখে বোঝা যায়, কয়লা উত্তোলন এখানে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। উন্মুক্ত খননের বিপক্ষে যখন এত তীব্র জনমত এবং দুই নেত্রীর অঙ্গীকারও রয়েছে, সেখানে বিশেষজ্ঞ দিয়ে অনুসন্ধান আর প্রতিবেদন তৈরিটা আমি মনে করি সময় ও অর্থ অপচয় ছাড়া কিছুই না। এখানে যে কোনো মূল্যে দুই পক্ষ ঐকমত্যে না পৌঁছালে কিছু হবে না। এটাই তাই আগে করা দরকার। সরকার যদি জ্বালানি সঙ্কট কাটাতে চায় তাহলে তার প্রধান কাজ হবে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টার সমাধান করা।’
উল্লেখ্য, পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে ১৭ সদস্যের এই রিভিউ কমিটিতে নতুন পুরনো আমলারা বাদে আরো আছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর, বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ আহমেদ, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডিউলিংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি, বুয়েটের অধ্যাপক এবিএম বদরুজ্জামান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান ইসলাম ও এশিয়া এনার্জির পক্ষাবলম্বনকারী বিতর্কিত জ্বালানি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার-এর সম্পাদক মোল্লা মোহাম্মদ আমজাদ।
এশিয়া এনার্জিকে পুনর্বাসন
বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মতো এ সরকারও যে কোনো মূল্যে এশিয়া এনার্জির হাতে কয়লাখনি তুলে দিতে উন্মুখ। ফুলবাড়ীর কয়লাখনির ওপর লন্ডনে এখনও শেয়ার ব্যবসা করছে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম)। কিন্তু এরকম কোনো চুক্তি না থাকলেও সরকার এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কথা বলেনি। বরং কিছুদিন আগে ফুলবাড়ী এলাকায় এশিয়া এনার্জির কাজে যাতে কোনো বাধা না আসে সে ব্যবস্থা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি মারফত নির্দেশ পাঠিয়েছে।
চিঠিতে জানানো হয়েছে, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে চুক্তি না থাকলেও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তারা অনুসন্ধানমূলক জরিপ চালাতে পারে। বর্তমান সরকারের নাকের ডগায় থেকে এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ীর কয়লা নিয়ে নানা কথা বলে আসছে। সরকার তাতে বাধা দেয়নি। এটা স্পষ্ট সরকার এশিয়া এনার্জিকেই ফুলবাড়ীতে চায় ঠিক আগের সরকারের মতোই।
ভেতরে ভেতরে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকারের নতুন চুক্তি সম্পাদনের কাজও এ লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। কিছুদিন আগেই খবরে প্রকাশ পেয়েছে, ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নে এশিয়া এনার্জি সরকারকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন এ প্রস্তাবে ৬ শতাংশ রয়্যালটি ছাড়াও ১০ শতাংশ ‘ইকুইটি শেয়ার’ প্রদান এবং নিজস্ব বিনিয়োগে খনিমুখে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা বিবেচনা করে নতুন প্রস্তাবে সরকারকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার টোপ দিয়েছে এশিয়া এনার্জি। সরকার এখনো সম্মতি না জানালেও কোনো বিরোধিতাও করেনি। অনেকেই মনে করেন, এবার এশিয়া এনার্জির এই টোপ গিলতে পারে সরকার। এমনিতেই তারা এশিয়া এনার্জিকে দীর্ঘদিন ধরে সুরক্ষা দিয়ে আসছেন।
ফুলবাড়ীর জনগণ এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে তাদের রায় দিয়ে আসছে। তারা উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে। ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র মানিক সরকার বলেন, ‘সরকার যাচ্ছে আসছে। তবে এশিয়া এনার্জি থেকে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায় সরকার আসলে মানুষের পক্ষে না, বিদেশি কোম্পানির পক্ষে। তবে আমরাও বলতে চাই, ২০০৬ সালে এই দুর্বৃত্তদের হটিয়ে দিতে ফুলবাড়ীতে মানুষ জীবন দিয়েছে। রক্তে লেখা ফুলবাড়ী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই রক্ত আমরা বৃথা যেত দিব না। ফুলবাড়ীর প্রতিটি মানুষ তাদের রক্ত দিয়ে হলেও এখানে বিদেশি কোম্পানির আগ্রাসন ঠেকাবে।’
সুন্দরবন ধ্বংস করতেই হবে!
অনেক বিরোধিতা, অনেক পত্রিকায় লেখালেখি সত্ত্বেও সরকার এখনো সুন্দরবনেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার পক্ষপাতি। পরিবেশগত সমীক্ষার ন্যূনতম শর্ত ভঙ্গ, জোরপূর্বক মানুষ উচ্ছেদ, সুন্দরবনসহ দেশের সর্বনাশ, ভারতের কোম্পানিকে সুবিধা দেয়াসহ আরো অনেক অভিযোগ আছে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে। প্রকল্পটির প্রস্তাবনার শুরু থেকেই পরিবেশবিদ, আইনজীবী, রাজনৈতিক সংগঠন ও আরও অনেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। প্রকল্পের শুরু থেকেই ভূমি অধিগ্রহণ আইন লঙ্ঘন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে পরিবেশ পরিণাম সমীক্ষার পূর্বেই বলপূর্বক প্রকল্পের জমি জবরদখল, প্রতিবাদী এলাকাবাসীর উপর সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি অনিবার্যভাবে বিশ্বের অমূল্য সম্পদ ও দেশের পরিবেশগত প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা বর্ম সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি করবে। বনের অপূরণীয় ক্ষতিসহ সংশ্লিষ্ট পশুর নদীর পানি দূষণ, ভূগর্ভস্থ জলাধারকে নিম্নগামী ও শূন্য করা, খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস করা, এলাকার মানুষের আশ্রয় ও জীবিকা হরণ ইত্যাদি ক্ষতি করবে। যা তথাকথিত লাভের তুলনায় বিপদ ডেকে আনবে অনেক বেশি। তাছাড়া প্রকল্পটিতে বাংলাদেশের দেয় বিদ্যুতের মূল্যের অনির্দিষ্টতা ছাড়া আরও অনেক দিক থেকে চুক্তিটিতে অনির্দিষ্টতা ও অনিশ্চয়তা জিইয়ে রাখা হয়েছে।
এত বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রস্তাবিত এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করেছে। ফলে এবার ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর মাধ্যমে সরকার সব মতকে পেছনে ফেলে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকেই এগিয়ে গেল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি এমএ মতিন এ বিষয়ে বলেন, ‘এটা খুবই হতাশার যে, সরকার কারো কোনো কথা শুনল না, কিছুতেই তাকে সিদ্ধান্ত থেকে নড়ানো গেল না। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে পরিবেশের ছাড়পত্রটি যেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে দেয়া হয়। এখানে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে গেলে সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চারটি আইন লঙ্ঘন করতে হবে। সরকার যদি আইন না মানে তাহলে আমরা কার কাছে কি চাইব।’
যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎসচিব আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবন থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্বেই আছে। আর পরিবেশের ক্ষতি যাতে কাটিয়ে উঠা যায় সে অনুযায়ী সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার পুরোপুরি আইন ভঙ্গ করে এটা গায়ের জোরে করছে। এ রকম একটি দূষণকারী শিল্প কিছুতেই কোনো বনাঞ্চলের পাশে হতে পারে না। প্রস্তাবিত আরেকটি জায়গা ছিল খুলনার লবণচরা। সেখানে এটা করা যেত। কিন্তু সুন্দরবনেই সরকারকে এটা করতে হবে। সব কিছুর মালিক সরকার। সরকার নিজে চাচ্ছে এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। তাই পরিবেশগত ছাড়পত্র তারা পাবেই। সরকার বনের ক্ষতি সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যাচার করছে। সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মানুষের উচিত এখানে বাধা দেয়া।’
উল্লেখ্য, অনেক আগেই ভারতীয় জাতীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি একই ধরনের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে ব্যর্থ হয় সে দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার মুখে। এনটিপিসি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিল মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায়। প্রস্তাবিত ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি সংরক্ষিত বন থাকায় দেশটির পরিবেশ অধিদপ্তর সেটি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। সেই একই প্রকল্প নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার পূর্বতন সিদ্ধান্তে অটল। সুন্দরবন রক্ষার দাবিকে তারা আমলে নেয়নি।
[প্রথম প্রকাশ : নাগরিকব্লগ। ১৪ নভেম্বর, ২০১২।]
https://m.facebook.com/story.
https://m.facebook.com/story.php?_e_pi_=7%2CPAGE_ID10%2C6541845207