চিটচিটে টি শার্টটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে লোকটার।গরম পড়ছিলো বলে দরজাটা হাট করে খোলা রেখেছিলাম ।পাগলটা কোথা থেকে জানি ঢুকে পড়েছে ।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি সোফায় ।লোকটা ঘরময় হাঁটছে ।অচেনা একটা লোক বাসায় ঢুকে পড়েছে ।এই মুহুর্তে আমার ভয় পাওয়ার কথা ।কিন্তু কেন জানি ভয় তেমনকরছেনা ।লোকটার ভঙ্গি বেশ সহজ ।যেন কত দিনের পরিচিত একটা বাসায় ঢুকে পড়েছে ।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ,আর ছাঁটা চুল লোকটার।চোখগুলো বেশ স্বপ্রতীভ,হাসি হাসি ।
ল্যাপটপটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,”এটা কি জিনিষ ?”
আমি অবাক হয়ে বললাম “ল্যাপটপ” !
চিটচিটে টি শার্টটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে লোকটার।গরম পড়ছিলো বলে দরজাটা হাট করে খোলা রেখেছিলাম ।পাগলটা কোথা থেকে জানি ঢুকে পড়েছে ।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি সোফায় ।লোকটা ঘরময় হাঁটছে ।অচেনা একটা লোক বাসায় ঢুকে পড়েছে ।এই মুহুর্তে আমার ভয় পাওয়ার কথা ।কিন্তু কেন জানি ভয় তেমনকরছেনা ।লোকটার ভঙ্গি বেশ সহজ ।যেন কত দিনের পরিচিত একটা বাসায় ঢুকে পড়েছে ।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ,আর ছাঁটা চুল লোকটার।চোখগুলো বেশ স্বপ্রতীভ,হাসি হাসি ।
ল্যাপটপটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,”এটা কি জিনিষ ?”
আমি অবাক হয়ে বললাম “ল্যাপটপ” !
লোকটা বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললো”ও” !”এটা দিয়ে কি গান শোনা যায়?”এমনভাবে ছুলো যেন প্রাগৌতিহাসিক কোন বস্তু দেখছে ।
আমি কোনমতে বিস্ময় গিলে বললাম ,
“গান শোনা ,যায় সাথে আরো অনেক কিছু করা যায়” !
লোকটা , মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ।”সবকিছু বদলে গেছে কেমন জানি ।জিম রিভসের রেকর্ড ভালো লাগতো ।শচীন আর ফিরোজার গান শুনতাম প্রচুর” ।এখন মনে হয় এদের তেমন খ্যাতি নেই আর !এই যেমন কেউ আমাকে চিনছেনা” !
“আপনি কে ?”
সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম এবার ,
লোকটা বললো ,”বলে লাভ কি !চিনবেনা আমাকে “।
আমি বললাম “বলেই দেখুন না” ।
একটু দম নিয়ে লোকটা বললো ,”আমার নাম রুমী ।পুরো নাম শাফী ইমাম ।পিতার নামশরীফ ইমাম ।মায়ের নাম জাহানারা ইমাম ।”
আমি ভয় আর বিস্ময়ের চুড়ান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে ভাবছি বলে কি পাগলটা !এতো মনে হয় সত্যি সত্যি পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে ।
লোকটা আমার পড়ার টেবিলের দিকে এগুলো ।সেখানে সবচেয়ে উপরের তাকে আম্মু আর আমার একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ রাখা ।
“তোমার মা ?”জিজ্ঞেস করলো লোকটা ।
আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়লাম ।নিজেকে রুমী বলে দাবী করা লোকটা অথবা পাগল টা ফটোগ্রাফটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি জানি বললো ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“আম্মা আর আমার এরকম একটা ফটোগ্রাফ ছিলো ।সাদাকালো ।তখন অবশ্য রঙ্গিন ছবির যুগ আসেনি ।”
“আম্মার রান্নার হাত ছিলো অসাধারণ ।আম্মার রান্না করা গরুর মাংস খেলে তুমিও তার ভক্ত হয়ে যেতে আমি নিশ্চিত।” লোকটা শিশুর মতো হেসে উঠলো বলতে বলতে ।
“অনেকদিন গরুর মাংস খাইনা ” ।লোকটার চোখের কোণায় পানি দেখলাম হঠাত্ ।
আমার বইয়ের সেলফটার দিকে তাকালো মানুষটা ।তারাশংকর আর মানিক সমগ্রদুটোতে হাত বোলালো ।আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
কাকে বেশী ভালো লাগে তোমার “তারা শংকর না মানিক ?”
দুজনেই সমান প্রিয় ,তবে মানিক বন্দোপাধ্যায় একটু বেশী প্রিয় ।”
নিজেকে রুমী দাবী করা লোকটা হাসলো ।
“আমারো মানিক বেশী পছন্দের ।প্রাগৌতিহাসিক গল্পটা আমার খুব প্রিয় ।পদ্মানদীর মাঝির হোসেন আলী হতে ইচ্ছে করতো মাঝে মাঝে ।এমন সমাজ নির্মাণ করবো যেখানে কোন শোষণ,বঞ্চনা ,অবিচার থাকবেনা ।”একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে একটু দম নিলো লোকটা,তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো বুকে । বললো ,”সেই স্বপ্ন নিয়ে ,এবং হায়েনাগুলোর উপর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম ।”
আমার হঠাত্ লোকটাকে প্রচন্ড ঠগ এবং বাটপার মনে হতে থাকে ।নিশ্চিতভাবে লোকটা একাত্তরের দিনগুলি পড়েছে ।রুমী আর জাহানারা ইমাম সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানে ।এর ভিত্তিতে বোলচাল ঝেরে আমাকে চমকে দিতে চাইছে ।যে কোন মূহুর্তে অস্ত্র বের করে আসলভেলকি দেখিয়ে দেবে ।আমার একই সাথে বিরক্তি ,ভয় এবং কৌতুহল হতে থাকে ।দেখি লোকটা খেলাটা কতদূর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।
আপনার ভাই জামি এখন কোথায় ?আমি লোকটাকে চমকে দিতে চাইলাম ।লোকটা বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাসফেলে বললো জানি না ।হয়তো চিনবে ই না ।সবাই যেমন চেনেনা ।আমি লোকটাকে বললাম বাদ দিন । যুদ্ধের কিছু গল্প বলুন ।লোকটা হঠাত্ রেগে গেল ।চোখ মুখদিয়ে আগুন বেরুচ্ছে যেন ।
গল্প !যুদ্ধ মানে গল্প তাইনা!তোমাদের জেনারেশনের কাছে যুদ্ধ মানেশুধুই গল্প ! তাইনা ।সকিংয়ের নাম শুনেছ ?প্লায়ার্স দিয়ে আঙ্গুলের নখ একটা একটা করে তুলে ফেলতে দেখেছ?মাথা উল্টিয়ে পা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে ফ্যান ঘোরাতে দেখেছ?হাহ্ !খালি গল্প শুনতে চাইবে ।যুদ্ধের বড় বড় বোলচাল ।আবেগী বীরত্ব গাঁথা ।শুকনো চোখের জল ।আর কত।পানি চাইলে পেতাম প্রশ্রাব !শুনতে চাইবে সেসব গল্প তোমরা ?
লোকটা এতো জোরালো গলায় আর ভয়ংকর ভঙ্গিতে বর্ণনা করছিলো যে ,আমি শিউরেউঠলাম ।
লোকটা হঠাত্ শান্ত হয়ে গেলো ।একসময় আমারো যুদ্ধ নিয়ে অনেক রোমান্টিসিজমছিলো ।তোমাদের মতো বয়স ছিলো তখন ।রক্ত টগবগ করে ফুটতো ।স্বপ্ন দেখার ব্যারাম ।সেই সাথে একাত্তরের দুঃস্বপ্ন ।সব মিলিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারিনি ।কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন।অসহ্য ,কদর্য ।গর্ভবতী মায়ের পেট থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা শিশুর যুগলবন্দী লাশ ,যেটা দেখেছিলাম যুদ্ধের সময় সেটার মতোই বিভত্স ।শান্তির সময়ে সেটা গল্প বৈ কিছু নয় ।
আমি দেখলাম লোকটা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে ।একটা তীর্যক জবাব দেয়া দরকার ।
আমরা বুঝবোইনা যখন এতো বড় বড় কথা বলে লাভ কি ?নিজের কথা নিজের ই রুক্ষ্ন মনে হল আমার কাছে ।লোকটা মৃদু হেসে বললো বলতাম না ।তুমি যুদ্ধের প্রসঙ্গটা তুললে তাই বললাম ।যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনা ভালো লাগেনা আর । অবশ্য যুদ্ধ ছাড়া আর চারণ করার মতো খুব বেশি স্মৃতিই বা কোথায় আমার জীবনে ।তুমি কিছু মনে করোনা ।ব্যাবহার বোধহয় একটু রুক্ষ ই হয়ে গেছে আমার ।শেষের দিকে ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলো ।আঙ্গুলের মাথায় আলপিন ঢুকিয়ে দিতো ।
আমি শিউরে উঠছি দেখে লোকটা বিব্রত হলো ।এইরে আবার শুরু করলাম যুদ্ধের প্যাঁচাল ।আসলে মানসিক ভারসাম্য ই বোধহয় একটু নড়ে গেছে শুয়োর গুলোর অত্যাচারে ।লোকটা একটু কাষ্ঠ হাসি হাসলো ।
আমি চুপ করে জানতে চাইলাম ,ওরা ঠিক কিজানতে চাইতো ?
আস্তানার ঠিকানা ,দলের অন্য পোলাপানদের নাম ধাম এইসব আর কি !
আমি শুকনো মুখে বললাম কেউ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বলে দিতোনা ?
লোকটা গম্ভীর মুখে বললো কেউ কেউ বলতোকেউ কেউ বলতোনা ।বেশীরভাগ ই বলতোনা ।বেশীরভাগ ই ছিলো অন্য ধাতুতে গড়া ।
আমি মুখ ফসকে বললাম আপনি বলেন নি কখনো ?
লোকটা কিছুক্ষণ নিরব থেকে উপরের দিকে চাইলো ।তারপর খুব ক্ষীণ স্বরে বললো না !
(শহীদ রুমী স্মরণে গল্পটা বড় হয়ে যাওয়ায় দুই পবে দিতে হচ্ছে ,কিছুক্ষণ পর আরেক পর্ব দেয়া হবে )
বেদনাদায়ক ।
আজ ২৯ আগস্ট ।৭১
বেদনাদায়ক ।
আজ ২৯ আগস্ট ।৭১ এর এই দিনে পাকিস্থানি সেনাদের হাতে রুমী সহ যারা আটক হয়েছিলেন, যারা আজও ফিরে আসেননি সেই সব বীরদের কথা আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ।
রুমীকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ
রুমীকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
আর, নেক্সট পর্ব এখন না দিয়ে কালকে দিবেন। ব্লগের নিয়মানুসারে প্রথম পাতায় একই লেখকের দুই পোস্ট থাকা যাবেনা।
দেশপ্রেমিক দেশপ্রেমিক বলে
দেশপ্রেমিক দেশপ্রেমিক বলে আমরা যারা আজ চিৎকার করে নিজেদের জাহির করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, তাদের জন্য রুমি খুব গুরুত্তপূর্ণ উদাহরন… এমআইটি তে পড়তে যাবার এক অসাধারণ সুযোগ পায়ে ঠেলে সে দেশকে বেছে নিয়েছিল আগে। :bow: :bow: :bow: আজকের রাজনীতিবিদের মধ্যে যদি রুমির দেশপ্রেমের ছিটেফোটাও থাকত, তাহলে হয়তোবা দেশের আজ এইরাকম অবস্থা হত না। আজকের এই দিনে রুমি সহ ক্রাক প্লাটুনের সকল যোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা… :salute: :salute: :salute: :salute: :salute: :salute: