প্রথম পর্ব এখানেঃ বিপ্লব !!!
(১)
জুম্মাবারের ঠান্ডা সুন্দর স্নিগ্ধ সকাল। ফজরের সালাত শেষে বাসায় যাচ্ছি। ইদানীং ফজরের সময়ও জামাত শুরুর ঘন্টাখানেক আগেই মসজিদে চলে যেতে হয়। নইলে প্রথম কাতার পাওয়া যায় না। বিপ্লবের পরে মানুষের সালাত আদায়ের হার অনেক বেড়ে গেছে কিন্তু সেই তুলনায় মসজিদের স্পেইস বাড়েনি। হুকুমত মসজিদের ফান্ড বাড়িয়েছে কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নে সময় লাগে। বিপ্লবের পরে এই ধরনের সমস্যা হবারই কথা। ধীরে ধীরে সব হবে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট- ফজরের সালাত-রত মানুষের মুখে যে ঈমানের দীপ্তি তার চেয়ে সুন্দর কিছু আসলেই নেই, এটা হাজারো সুন্দর ইমারত থেকেও লক্ষ-কোটিগুণ বেশী সুন্দর। একেকজনের চেহারা থেকে যেন ঈমানি নুর ঠিকরে বের হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো লাগে সালাতে আসা ছোট ছোট বাচ্চাদের। নিষ্পাপ ফুলের মত মুখ ওদের। এতো ছোটবেলা থেকেই ইসলামী পরিবেশে নিজেদের মাঝে ঈমান গেঁথে নিতে পারছে ওরা। ওদের মাঝ থেকেই উঠে আসবে উম্মাহর সেই মুজাহিদ দল যারা হোয়াইট হাউজ-ক্রেমলিনে কালিমার ঝান্ডা ওড়াবে।
বাসায় যাবার পথে প্রথম মোরেই মুসলিম সুইটস। বিপ্লবের আগে এটা ছিলো মুশরিক মালিকানায়। নাম ছিলো জগন্নাথ মিষ্টান্ন। যতিন আর আমি প্রায়ই সকালে এখানে নাস্তা সারতাম। এখন খুব একটা যাওয়া হয়না। আম্মার জব চলে যাবার পরে এখন ব্রেকফাস্ট বাসায়ই করি। তাছাড়া আগের মানও নেই এখন। তবে কিছুদিন আগে এক ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি আগের মুশরিক মালিক গো-চণা মেশাতো সবকিছুতে। ভাবতেই সব গুলিয়ে উঠছে। কী খেয়েছি এতদিন! আল্লাহ সুবহানুতাআলা মাফ করুক। এদিক থেকে ভালোই হয়েছে। এখন কাস্টমাররা পাক-সাফ থাকতে পারছে। আল্লাহ সুবহানু তা’আলাহ নিশ্চয়ই বারাকাহ দিবেন। আমাদের বাড়ির চারটি বাড়ি আগেই যতিনদের বাসাটা। নতুন কোন ফ্যামিলি উঠেছে এখন। উঠানের জবা গাছটি আর নেই। গাছটা কেটে ফেলা ঠিক হয়নি। গাছের আবার হিন্দু-মুসলিম কি। তাছাড়া রাসুল ﷺ গাছ ও শস্যের ক্ষতি করতে নিষেধ করেছেন। শুনেছি যতিন রিভার্ট করেছে। এখন দাওলাহর রি-এডুকেশন ক্যাম্পে আছে। সেখানে নও মুসলিমদের সমীহ দীন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। বছর-খানেক লাগবে প্রোগ্রাম শেষ হতে। একজন মু’মিন বন্ধু বাড়লো। সুরোভী আর ওর মায়ের খবর পাচ্ছিনা অনেকদিন। উনাদের মালিকরা মেইলের রিপ্লাই দিচ্ছে না। ভালোই থাকার কথা ইনশাল্লাহ।
বাসায় ফিরে নাস্তা সারতে বসলাম। আম্মা নাস্তা বেরে দিলো। আম্মা এখন সারাদিন বাসায়ই থাকতে পারে, আলহামদুলিল্লাহ! দাওলাহ ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মাঝেই প্রায় সব মহিলা কর্মকর্তা কর্মচারীকে অবসর দিয়ে দেয়। কর্মক্ষেত্রে অশ্লীলতা রোধে একেবারে কার্যকর পদক্ষেপ। এই নিয়ে সেক্যুলাররা অনেক পানি ঘোলা করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু লাভ হয়নি। দাওলাহর হুকুমতের উপর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিলো। এই সমর্থন ও ভালোবাসার একটা কারণ- হুকুমতের দুর্নীতি-অনিয়ম ও অশ্লীলতার প্রতি জিরো টলারেন্স। এখন কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেই অবিলম্বে শরীয়া কোর্ট শাস্তি দিয়ে দেয়। কয়েকটি প্রকাশ্য শাস্তির পরেই বাকি সবাই সোজা হয়ে যায়। এখন জনগণ বিনা ঘুষেই খুব কম সময়ে সরকারী সেবা পাচ্ছে। দেশটা কল্যান রাস্ট্রে পরিনত হয়েছে। এমন বাংলাদেশ কেউ দেখেনি আগে। ছিচকে চোর থেকে রাঘব বোয়াল সব ধরা। বার, জুয়ার আসর, গানের আসর এসব অশ্লীল আর ফাহেসা কর্মকান্ড বন্ধ। মহান মুক্তিযোদ্ধারা-তো এমন বাংলাদেশই চেয়েছিলেন।
নাস্তা সেরেই আমার রুমে চলে এলাম। সেলফে কয়েকটি প্যারাডক্সিকেল আরিফ সাজানো। সামনের বইমেলার জন্য নতুন সংস্করণ বের করবো। বইগুলো আমার নিজের সন্তান। তাগুতি শাসনের কালে যখন যুব-সমাজ ইসলাম-বিদ্বেষীদের প্রপাগান্ডায় ভেসে যাচ্ছিলো তখন এই বইটি অনেকের ঈমান রক্ষা করে। সেই ঈমানের তেজেই ধীরে ধীরে সমাজটা পালটে যেতে থাকে। যুব-সমাজের মন থেকে ইসলাম নিয়ে সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়। সালিফ আদনান ভাই এই বইয়ের যতই সমালোচনা করুক না কেন, এই বিপ্লবের পেছনে আমার বইগুলোর কিছুটা হলেও অবদান আছে। সালিফ ভাইয়ের সাথে আমি সম্পর্ক ঠিক করে নিয়েছি আবার। আমরা তো আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসি। আমাদের দীনি বিষয়ে ইখতিলাফ ছিলো, কোন ব্যক্তিগত বিষয়ে না। আমরা এখন মাঝে মাঝেই একসাথে আড্ডা দেই। ইসলামের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।
টেবিলের উপর আরেকটা বই। ট্রিপল-স্ট্যান্ডার্ড। ডাঃ শক্তিশালী আহমেদের লেখা। প্রথম চ্যাপ্টারটা পড়া হয়েছে। দাস-প্রথা নিয়ে। ইসলাম যে কত প্র্যাক্টিকেল দীন তা শক্তিশালী ভাইয়ের লেখা পড়লে বোঝা যায়। উনি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে রেফারেন্স সহ দেখিয়ে দিয়েছেন ইসলামে দাসপ্রথার মানবিকতা। মুক্তমনা ইসলাম-বিদ্বেষীদের ভদ্র ভাবেই একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে উনি ইসলামি দাসপ্রথার সাথে আধুনিক দাসপ্রথার তুলনামুলক বিশ্লেষণ করেছেন। দেখিয়েছেন পশ্চিমা কুফফাররা কীভাবে লুকিয়ে চুড়িয়ে দাসপ্রথাকে এখনো জীবিত রেখেছে। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই মুত্রমনা-ইসলাম-বিদ্বেষীরা কী এগুলো দেখতো না। ডাঃ শক্তিশালী ভাই মুক্তমনাদের ভণ্ডামি একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন। আজকে দ্বিতীয় অধ্যায়টা পড়বো। এই অধ্যায়ের নাম- “দক্ষিণহস্ত মালিকানা: একটি নারীবাদী বিধান”। জাজাকাল্লাহ খাইরান শক্তিশালী ভাই!। আল্লাহ আপনার জ্ঞান আরও বাড়িয়ে দিক। একেবারে দ্বিতীয় অধ্যায়েই এত স্পর্শকাতর একটা টপিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। নাস্তিকরা পালাবে কোথায়!
(২)
দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ করলাম। জাজাকাল্লাহ খাইরান! উনি এতো সুন্দর করে দাসীদের বিষয়টা তুলে ধরেছেন যে এর পরে তেমন কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। আসলেইতো একটা যুদ্ধের পরে মু’মিনরা যেভাবে কুফফার নারীদের আশ্রয় দেয় সেটা আর কোন তন্ত্রে সম্ভব ছিলো! আর তাছাড়া এই সকল বন্দী কুফফার নারীরাও রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও শারীরিক চাহিদা আছে। মু’মিনদেরতো এসব বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। ইসলামের বিধান কত নিখুঁত। ইসলাম মানুষের সব চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রেখেছে। মানুষের প্রতিটি চাহিদার দিকে খেয়াল রেখেছে। হযরত সাঈদ কুতুব রহিমাহুল্লাহ ঠিকই বলেছিলেন-
“ইসলাম ইজ নট অ্যা সিভিলাইজেশান, ইসলাম ইজ সিভিলাইজেশান, এভরিথিং এলস ইজ জাহিলিয়া, বর্বরতা।”
কিন্তু একটা জায়গায় একটু খটকা লাগলো। শক্তিশালী ভাই রেফারেন্স সহ দেখিয়েছেন যে দাসী যদি মুশরিক হয় তাহলে মালিকের ইন্টারকোর্স করা নাজায়িজ হবে। অথচ ইমারতে দাওলাহ এটাকে এলাও করছে। সালিফ ভাইকে জিজ্ঞেস করবো এই বিষয়ে। আপাতত রেফারেন্সটা টুকে রাখলাম। আল-কুর্তুবি রহিমাহুল্লাহ নোট করেছেন সুরা বাকারার ২২১ নং আয়াত থেকে-
”মুশরিক নারীদের নিকাহ করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে।”
-আল বাকারাহঃ ২২১
তিনি দেখিয়েছেন যে ক্লাসিক্যাল এরাবিকে নিকাহ শব্দটি বিবাহ ও যৌনমিলন দুই অর্থেই ব্যবহৃত হত। সুতরাং এই আয়াত দ্বারা মুশরিক দাসীদের সাথে ইন্টারকোর্স নাজায়েজ হয়ে যায়। যাহোক, প্রায় ১২ টা বাজে। গোসল করেই জুম্মা পড়তে যেতে হবে।
গোসল শেষে রেডি হচ্ছি এমন সময় একটা ই-মেইল পেলাম। সুরোভীর মালিকের মেইল। সুরোভী নেই। সুইসাইড করেছে।
(৩)
তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসলাম। অস্থির লাগছে। সালিফ ভাইকে বাসায় আসতে বলেছি। আম্মা খেতে ডাকছে। যাইনি, খিদা নেই। এমন সংবাদ শুনে কিছু খেতে ইচ্ছাও করে না।
কী এমন হল যে সুরোভী সুইসাইড করলো! তবে কি মালিক কোন জুলুম করেছে? ইসলাম ইজ দা বেস্ট দীন অ্যান্ড মুসলিমস আর দ্যা ওয়ার্স্ট ফলোয়ার্স। এখানে দীনের কোন দোষ নেই। আল-কুরআন সত্য। এখন পর্যন্ত আল-কুরআন থেকে কেউ একটিও ভুল বের করতে পারেনি। দীন-ইসলাম সত্য। এই ঘটনার জন্য যদি কেউ দায়ী হয় সেই দায় ব্যাক্তির, ইসলামের না।
সালিফ ভাই বাসায় এসে সোজা আমার রুমে চলে আসলেন।
“ওয়াল্লাহি জারিফ ভাই! আপনার মুখ এতো শুকনা দেখাচ্ছে কেনো? কী হয়েছে?”
“যতিনের বোন সুরোভী সুইসাইড করেছে।”
“ওয়াল্লাহি! কখন?”
“গতকাল রাতে। আজ দাফনও হয়ে গিয়েছে। দাসী বলেই হয়ত এত দ্রুত দাফন।”
“দাফন হয়েছে? তাইলেতো নিশ্চই ঈমান এনেছিলো। আল্লাহ জান্নাত দান করুক। যদিও আগে সুইসাইড এর শাস্তি পাবে।”
“সালিফ ভাই, এমনও-তো হতে পারে যে ঈমান আনেনি।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! তাহলে-তো সে চিরকালের জন্য জাহান্নামী। কুফরের চাইতে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে।”
“হুম।”
এদিকে আমার মনের মাঝে দাওলাহর দাসী বিষয়ক নীতি আর শক্তিশালী ভাইয়ের দেয়া রেফারেন্স টা আমার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।
“একটা ব্যাপার ভাই, দাওলাহকে ভালোবাসি আল্লাহর জন্য। তবে দাওলাহর একটা নীতির ব্যাপারে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনাকে করব?”
“দেখুন জারিফ আজাদ ভাই, দাওলাহর নীতি নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। দাওলাহ তো উম্মতের জন্য আল্লাহর এক নেয়ামত। তবে নীতির প্রশ্নে সালফে সালেহিনের বুঝের আলোকে হয়তো মতামত দিতে পারি।”
সালিফ ভাইকে মুশরিক দাসীর সাথে ইন্টারকোর্স বিষয়ক সুরা আল বাকারাহ-র রেফারেন্সটা দেখলাম।
“ভাই পুরো আয়াতটি পড়েছেন?”
“না।”
“ভাই, কুরআনের অনুবাদ বের করুন। বাংলা ইংরেজী দুটোই।”
অনুবাদ দুটো বের করলাম। সবসময় হাতের কাছেই থাকে।
“এবার সুরা বাকারার সংশ্লিষ্ট আয়াতটি বের করুন।”
“আর মুশরিক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত নিকাহ করো না। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, অবশ্যই মুমিন কৃতদাসী তার চেয়ে উত্তম। ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমরা নিকাহ দিওনা, মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও অবশ্যই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। তারা আগুনের দিকে আহবান করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ ইচ্ছায় জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন। আর তিনি মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তারা শিক্ষা নিতে পারে।” – আল-বাকারাহঃ ২২১
“দেখেছেন জারিফ আজাদ ভাই? এই আয়াতেই আপনার প্রশ্নের উত্তর আছে। এখানে নিকাহ বলতে কিন্তু সামাজিক বিয়ের কথা বলা হয়েছে, যৌনসঙ্গম বোঝানো হয়নি। তৃতীয় সেন্টেনসটি দেখুন- মুশরিক পুরুষদেরকে কোন মুসলিম নারী নিকাহ করতে পারবে না। ভালো করে দেখুন- মুসলিম নারীকে মুশরিক পুরুষের সাথে নিকাহ করতে মানা করা হয়েছে। এখানে নিকাহকে যদি যৌনসম্পর্ক অর্থে ধরি তাইলে বলতে হয়- পুরুষ কৃতদাসের আর তার নারী মনিবের মাঝে এমনিতেইতো যৌনসম্পর্ক হারাম। মুশরিক দাসের জন্য এটিতো এখানে আলাদাভাবে বোঝানোর দরকার নেই। তাহলে বোঝা গেল যে নিকাহ শব্দটি দ্বারা বিবাহ চুক্তিকেই বোঝানো হয়েছে, দাসীর সাথে যৌনসম্পর্ক নয়।”
“হুম, তাইতো। আমাদের অবশ্য এই আয়াত নাজিলের কন্টেক্সটটাও একটু বুঝতে হবে। একটা তাফসির চেক করবো?”
“হ্যা নিয়ে আসুন।”
ইবনে আব্বাসের তাফসীর এনে দিলে সালিফ আদনান ভাই সংশ্লিষ্ট আয়াত চেক করতে বসলেন।
“দেখুন এখানে- এই আয়াতটি নাজিল হয়েছে মারতাদ ইবনে আলি মারতাদ রাদিয়াল্লাতালানহু নামক একজন সাহাবী যখন একজন মুশরিক নারীকে বিবাহ করতে চান তখন। সুতরাং এখানে আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল প্রাতিষ্ঠানিক নিকাহ বা বিবাহকে বুঝিয়েছেন এবং সালফে-সালেহিনেরও বুঝও তাই ছিলো। আমাদেরকেতো আয়াতগুলো বুঝতে হবে সালফে সালেহিনের বুঝ থেকে, পরবর্তী কোন আলেমের বুঝ থেকে না। পরিষ্কার হল কেন এই নীতি নিয়েছে দাওলাহ?”
“হ্যা।”
“তাছাড়া বহু সহীহ হাদিস কিন্তু পাওয়া যায় যে সাহাবী রাদিয়াল্লাতালানহুম মুশরিক দাসীদের সাথে সঙ্গম করতেন। এর বিরুদ্ধ কোন মত কিন্তু কোন হাদিসে পাওয়া যায় না।”
“হুম সেটাইতো দেখছি।”
“জারিফ ভাই, আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবাসি। তবে একটা কথা বলি। মনে কষ্ট নিবেন না। আপনার মাঝে ঈমানি দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি। আপনি কুফফারদের প্রতি সহানুভূতিশীল। জারিফ ভাই, কুফফারদের ঠিক করে দেয়া নৈতিকতা আমাদের অনেককেই গ্রাস করেছে। এজন্যই আমরা শরীয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই থাকি, তুলতেই থাকি। জারিফ ভাই, আমাদের সবার হিসেবেই এমন কোন না কোন অপরাধী আছে যাদের মৃত্যুতে আমরা খুশি হবো। খুনি, ধর্ষণকারী, গোহত্যাকারী, এধরনের অপরাধীদের মৃত্যুতে কিন্তু আমরা খুশিই হই, উল্লাস প্রকাশ করি। অথচ এই অপরাধগুলো থেকেও বড় অপরাধ হল শিরক এবং কুফর। খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, কিংবা অন্য কোন অপরাধ কুফর কিংবা শিরকের মতো গুরুতর না। এই সবগুলো অপরাধ আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেবেন কিন্তু শিরক আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন না। একজন কুফফার যদি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পরোপকারীও হয় তবুও সে দোষী। সবচেয়ে বড় অপরাধ হল আল্লাহ্র একত্বকে অস্বীকার করা, শিরক করা। আমাদের মাথায় না ঢুকলেও এটা সত্য, কারণ এটা আল্লাহর কথা। এটা আমার কথা না আল্লাহ্র কথা। পৃথিবীর বুকে এমন কোন মুসলিম নেই যে এ কথা অস্বীকার করতে পারবে। আপনি পারবেন?”
“না।”
“তাহলে কেন ভাই? শরীয়া নিয়ে প্রশ্ন করেন কেন? কেন মুশরিক-কুফফারের অপমান, ধ্বংস, মৃত্যুতে মন খারাপ করেন? আপনার বরং উল্লাস করা উচিত”
“ওয়াল্লাহি সালিফ আদনান ভাই! আমার মন খারাপ না। তবে উল্লাসটা ঠিক আসছে না।”
“পরিপূর্ণভাবে দীনে প্রবেশ করুন, উল্লাস আসবে। আছরের সময় হয়ে গেল প্রায়। উঠতে হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী মসজিদে সালাত আদায় করবো। সেখানে রাতে শায়খ আবু হানজালা হাফিজাহুল্লাহর সাথে দেখা করতে হবে। উনি দাওলাহের একজন উপদেষ্টা। যেমন ইলম তেমনই জিহাদী জজবা উনার। আপনি যাবেন? উনার সান্নিধ্যে কিছুদিন থাকলে শয়তানের সব ওছওয়াছা দূর হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।”
“বারাকাল্লাহি ফিক সালিফ ভাই। কিন্তু আজ যেতে পারছিনা। পরে একদিন ইনশাল্লাহ! সামনে বইমেলা আসছে। এবার আমার প্রথম বইটির চল্লিশতম সংস্করণ বের করবো ইনশাল্লাহ। মাগরিবের পরে মেনুস্ক্রিপ্টটা নিয়ে একটু বসতে হবে। অনুমোদনের জন্য পাঠাবো। এখনতো প্রকাশনার আগে দাওলাহর অনুমোদন নিয়ে নিতে হয়।”
“নো প্রবলেম জারিফ ভাই।”
সালিফ ভাইকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিলাম। বের হবার আগে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন-
“জারিফ ভাই, আপনার যে মন খারাপ তা আমি জানি। কিন্তু ভাই আমাদের ‘শুনলাম ও মানলাম’ নীতিতে চলতে হবে। অভিশপ্ত ইয়াহুদী-নাছারারা শুনতো আর তারপর প্রশ্ন করতো। মানতো না। হাদিসে এমন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যুক্তি-তর্ক দিয়ে যদি সবকিছু জাস্টিফাই করতে যান তাইলে কিন্তু অনন্তকাল যুক্তিতর্কের ফাঁদেই পরে থাকবেন। ঈমান হারাবেন। চিরকালের জন্য জাহান্নামে যাবেন।”
“সালিফ আদনান ভাই! ঈমানের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই ইনশাল্লাহ! আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার। আমি জানি আল-কুরআন সত্য। এখন পর্যন্ত কেউ আল-কুরআনের একটি কথাও ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। এর চেয়ে বড় মিরাকল আর কী হতে পারে! এটিই প্রমাণ করে ইসলামই একমাত্র দীন। আমার মনে কোন সংশয় নেই সালিফ ভাই। চিন্তা করবেন না। আমি শুনলাম ও মানলাম।”
(৪)
এই মুহুর্তে আমি দাওলাহর স্থানীয় ক্যাম্পে। আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। গত সপ্তাহে আমার প্যারাডক্সিকেল আরিফের চল্লিশতম সংস্করণটি রিভিউ এর জন্য জমা দিয়েছিলাম। এজন্যই আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। দাওলাহর তথ্য দপ্তরের কর্মকর্তা আমার সাথে দেখা করতে চান।
“জারিফ আযাদ সাহেব, আপনার জন্য একটি দুঃসংবাদ ও একটি সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। বলুন কোনটি আগে দিবো”
“দুঃসংবাদটি আগে দিন যাতে সুসংবাদটি শুনে মন হালকা করতে পারি।”
“আচ্ছা। আপনার বইটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হবে না। তথ্য অধিদপ্তর এই বইয়ে অনেকগুলো ঈমান-আকিদা বিরোধী এলিমেন্ট খুঁজে পেয়েছে। এই বই তরুণ প্রজন্মের ঈমানের ক্ষতির কারণ হবে।”
“ওয়াল্লাহি!!! কিন্তু আমার এই বইইতো একসময় তরুণ প্রজন্মকে নাস্তিকতা ও ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রপাগান্ডা থেকে রক্ষা করেছিলো।”
“বি-কেয়ারফুল জনাব জারিফ। আপনার বই রক্ষা করেনি। আল্লাহ সুবহানুতাআ’লা রক্ষা করেছিলেন। আপনি কিন্তু শিরক করছেন। শিরকের চাইতে বড় গুনাহ নেই।”
“ওয়াল্লাহি! আমি তওবা করছি। আমি এভাবে বলতে চাইনি। তবে আমার বইটা একটা উছিলা ছিলো। এটা অস্বীকার করা যাবে?”
“দেখুন জারিফ আযাদ, আসলে আপনার বই হয়তো তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তখন ইসলাম ছিলো তাগুতি শাসনে বিপর্যস্ত। অনেকটা মাক্কি যুগের মতন। তখন মানুষের বুঝের জন্য আপনি এটা লিখেছিলেন। কাজে দিয়েছিলো হয়তো। অনেকে নাস্তিকতা থেকে ফিরে এসেছিলো। অনেকে নাস্তিক হতে হতেও আপনার বই পড়ে ঈমানের পথে ফিরে আসে। আমি নিজেই তার উদাহরণ। অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন ছিলো। আপনার বইতে তার উত্তর পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু তার মানে কিন্তু এই নয় যে আপনার উত্তরগুলো সহীহ আকিদার আলোকে সঠিক। রিভিউয়াররা আপনার লেখায় অনেক আকিদাগত সমস্যা পেয়েছে। আপনাকে বুঝতে হবে যে এখন কিন্তু ইসলামের বিজয় হয়ে গিয়েছে। আপনার বইএর এখন আর কোন প্রয়োজন নেই। দেশে এখন আর কোন নাস্তিক নেই। এখন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সহীহ আকিদার বুঝ দিতে হবে। তবে আপনি যদি সহীহ আকিদার আলোকে লেখাটি রিভাইস করেন তাহলে ছাপা হতে পারে।”
“আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে রিভাইস করে ছাপার সুযোগ আছে।”
“নিশ্চই নিশ্চই। কেন নয়!”
“যাক তাহলে আমি রিভাইস শুরু করে দেই এখনি। আমাকে রিভিউয়ারদের ফিডব্যাক দিন, আজই কাজ শুরু করে দেই। মেলারতো মাত্র তিন মাস আছে। অনেক কাজ।”
“সবর করুন জারিফ সাহেব। রিভাইস করার অনেক সময় পাবেন পরে ইনশাল্লাহ! আপাতত আপনাকে সুসংবাদটি দিতে দিন।”
“ওয়াল্লাহি! ভেবেছিলাম সুসংবাদটি অলরেডি দিয়ে দিয়েছেন। হা হা। প্লিজ বলুন।”
“হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে জনাব জারিফ, হাদিসে আছে। যাই হোক। সুসংবাদটি হল- দাওলাহ আপনার আকিদা শুদ্ধ করার জন্য আপনাকে একটি ট্রেইনিং প্রোগ্রামে পাঠাচ্ছে। সব খরচ দাওলাহই বহন করবে। ট্রেইনিং হবে চট্টগ্রামের রি-এডুকেশন ক্যাম্পে। আপনার প্রয়োজনীয় জিনিশপত্রের একটা লিস্ট দিন। এখনি আমাদের লোক আপনার বাসা থেকে সেগুলো নিয়ে আসবে। আপাতত আপনি আমাদের এখানেই থাকবেন। সামনের শনিবার আপনাদের একটা স্পেশাল ট্রেইনে চট্টগ্রাম পাঠানো হবে।”
(৫)
কমলাপুর রেল স্টেশন। আমাদের স্পেশাল ট্রেইনের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদেরকে খাঁচার মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রতিটি খাঁচায় পনেরো থেকে বিশ জন করে মানুষ। অনেকগুলো খাঁচা পাশাপাশি। চিরিয়াখানার মতন। প্রতিটি খাঁচা দাওলাহর মুজাহিদরা পাহারা দিচ্ছে। আম্মা, আব্বা আর সালিফ ভাই দেখা করতে এসেছে। এই ভ্যাপসা গরমে আম্মা কালো মোটা বোরকা আর হাতমোজা পরে এসেছে। কিন্তু জাহান্নামের আগুন এর চাইতেও বহু গুন গরম। দীনের জন্য প্রতিটি মু’মিনার মুজাহাদা আমাকে অবাক করে দেয়। খুব ভালো লাগছে।
আমার খাঁচায় গায়ক হায়দার হোসেন ভাই আছেন। আরও আছেন নোবেল ভাই আর মাইলস ব্যান্ডের শাফীন আহমেদ ভাই। ওনাদের ছয়মাস করে রিএডুকেশন ক্যাম্পে থাকতে হবে। উনারা ইসলামী বিপ্লব উদযাপনের জন্য রবীন্দ্র সরোবরে ইসলামী কনসার্ট করেছিলেন। সবকিছু ইসলামী উসুল মেনেই আয়োজন করা হয়েছিলো। নারী পুরুষের আলাদা প্যান্ডেল ছিলো। ব্যাপক লোকসমাগম হয়। ইসলামী সরকার দুর্নীতি ও অশ্লীলতা বিরোধী জোরালো পদক্ষেপ নেয়ায় এখন তরুণদের মাঝে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। তাকবীরে তাকবীরে ভেসে যাচ্ছিলো রবীন্দ্র সরোবর। বিপত্তি বাধে উনারা গিটার বাজানো শুরু করায়। নৈতিক পুলিশের কাছে সাথে সাথেই খবর চলে যায়। গ্রেপ্তারের পরে কাজী পঞ্চাশটি করে দোররার সাজা দেয়। রবীন্দ্র সরোবরেই প্রকাশ্যে দোররার সাজা কার্যকর হয়। সাথে আরও যোগ হয় ছয় মাসের রি-এডুকেশন। উনারা অবশ্য এসব শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছেন। ভুল বুঝতে পেরেছেন। কেবল শাফিন ভাইয়ের মন খারাপ জনসম্মুখে দোররা খাওয়ায়। তবে এটাই ইসলামী উসুল। শরীয়ার শাস্তির উদ্দেশ্যতো অপরাধীকে কষ্ট দেয়া বা অপমান করা না। বাকি সবাইকে সাবধান করে দেয়া।
স্পেশাল ট্রেইন এইমাত্র আসলো। এটা সাধারণ কোন ট্রেন নয়। অনেকটা মালগাড়ির মতন। কোন জানালা নেই।
তৃতীয় পর্বঃ বিপ্লব-৩ !!!
সত্যিই, ইছলাম সবচেয়ে সেরা ধর্ম, না ধর্ম না জীবন বিধান।