বাংলাদেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ কি শুরু হয়ে গেছে নাকি হয়নি, এ নিয়ে চলছে জল্পনা কল্পনা। বাংলাদেশ সরকার আসন্ন ১৭ মার্চ মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠান থেকে কোনোমতেই পিছু হঠতে চায় না। এ কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলেও তা গোপন রাখা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বাংলাদেশে এখনও করোনা সংক্রমণ না ঘটার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে।
বিবিসি সরাসরি অভিযোগ তোলেনি, কারণ তাতে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মোটেও দ্বিধা করবে না হাসিনার সরকার। কিন্তু আলোচিত এ ব্রিটিশ মিডিয়া ঠিকই প্রশ্ন তুলেছে, বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের করোনা হয়েছে কিনা, তেমন পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই ঢিলেঢালা হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে দেশটি করোনা সংক্রমণ এড়িয়ে থাকতে পারছে? যেখানে কিনা পাশের দেশ ভারতে ইতিমধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে এবং অনেক দেশেই তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
বিবিসি বাংলা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “এই মুহূর্তে একের পর এক দেশে নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশকেও বলা হচ্ছে উচ্চ-ঝুঁকির দেশ। কীভাবে করোনা শনাক্ত এবং ভাইরাস রোধে কাজ করছে বাংলাদেশ এ নিয়ে উচ্চ আদালতও জানতে চেয়েছে। এমন সন্দেহ আর বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে স্বভাবতই করোনা আতঙ্ক আর উদ্বেগ ভর করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বাংলাদেশে কখন এ ভাইরাস ঢুকে পড়ে, নাকি অজান্তে ঢুকেই পড়েছে, অনেকের মধ্যে কাজ করছে সে সন্দেহ।”
জনমনে এমন ধারণা প্রবল যে, ব্যাপক আয়োজন ও খরচের পর এখন বাংলাদেশ সরকার আর মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা থেকে পিছিয়ে আসতে চাইছে না। ফলে করোনা সংক্রমণ ঘটে থাকলেও সরকার সেই তথ্য ফাঁস হতে দিচ্ছে না। এমনটা ঘটোলে পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খুব খারাপের দিকে চলে যাবে। চীন প্রথমে করোনা সংক্রমণের ব্যাপারটি টের পায়নি, চিকিৎসকরা জানানোর পর সে দেশের সরকার বিষয়টিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে ভাইরাসটি সবার অজান্তে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে ভাইরাস সংক্রমণের শিকার রোগীর সম্পর্কে তথ্য নেয়ার মাধ্যমে অন্য দেশগুলো করোনার বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার যদি করোনা সংক্রমণের খবর গোপন করে, তাহলে রোগীরা অবাধে চলাফেরা করবে এবং তাদের হাঁচি, কাশি, কফ, থুতুর মাধ্যমে এ রোগ সারা দেশে এবং দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে। এই ভাইরাসের বিস্তৃতি ঠেকাতে হলে রোগীকে আলাদা স্থানে (কোয়ারেন্টাইন) রাখার নিয়মই সারা বিশ্বে অনুসরণ করা হচ্ছে। চীনও এ কারণে দ্রুতই এ রোগ সম্পর্কে খবর প্রকাশে বাধ্য হয় এবং আক্রান্ত এলাকাকে অন্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিন্তু হাসিনা সরকার মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে হয়তো বাংলাদেশের কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
তবে এখন অবধি যদি বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ নাও ঘটে থাকে, তাহলেও শঙ্কা থাকছে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানকে ঘিরে। করোনা সংক্রমণে চীনের পর সবচেয়ে বিপদে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার ঘটনা থেকেই এমন আশঙ্কা। দেশটিতে এক ধর্মনেতার মৃত্যুর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিপুল মানুষের জমায়েত থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী মোট ৬ হাজার ২৮৪ জন আক্রান্তের খবর জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। ইতিমধ্যে সে দেশে ৪২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ অবস্থায় এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। একের পর এক বাতিল হচ্ছে আন্তর্জাতিক নানা অনুষ্ঠান। ইরাক ও ইরানে জুম্মার নামাজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মক্কায় মুসল্লি সমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইটালিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ফুটবল মাঠে দর্শক ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি স্কুলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটেই আসছে ১৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হবার কথা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে অতিথিদের যোগ দেবার কথা রয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য ছাড়াও আতশবাজি এবং কনসার্টও থাকবে। স্বভাবতই সেখানে হাজার-হাজার মানুষের সমাবেশ হবে। আওামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা দেশ থেকে এবং দেশের বাইরে থেকেও আসবেন এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। যদিও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে লোক জমায়েত বন্ধ করে দিয়েছে সেসব দেশের সরকার।
বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো যেখানে এখন সব বড় জমায়েতের অনুষ্ঠান বাতিল করছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার এখনও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনে অবিচল। অথচ ওসব দেশের সামর্থ্য বাংলাদেশের চেয়ে ঢের বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, শেখ হাসিনা কোটি কোটি মানুষের নিরাপত্তা বা দেশের অর্থনীতির ঝুঁকি তোয়াক্কা করছে না। পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে করোনা সংক্রমণ ঘটার ব্যাপক শঙ্কা সত্ত্বেও হাসিনা সরকার সেই ঝুঁকি নিতে পিছ পা হচ্ছে না।
সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই বুঝতে পারবেন যে, এখনকার পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধই যেকোনো সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়ার কথা। অথচ বাংলাদেশ সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনে। সরকারের কর্তব্য ছিল করোনা ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া। বর্তমান সংকটজনক অবস্থায় ইটালির মতো উন্নত ইইউভুক্ত দেশও মাস্কসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে ভুগছে। বড় ও উন্নত দেশগুলো এবারের ঘটনায় অন্য দেশের প্রতি সাহায্যের হাত কমই বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এ অবস্থায় বিশ্ব থেকে খুব বড় কোনো সাহায্য পাবে না। তাই সরকারের সামর্থ্য এখন করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার উল্টো উচ্চমাত্রায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
শেখ মুজিব কে ছিলেন, কী ছিলেন তা নিয়ে বাংলাদেশে নানা দ্বন্দ্ব-মতভেদ আছে। তবু দেশের মানুষের বেশির ভাগের মধ্যেই তার সম্পর্কে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ এখন পর্যন্ত জারি আছে। কিন্তু মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পাড়ায়, মহল্লায়, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী মহলে ব্যাপক চাঁদাবাজিতে সবাই অস্থির। এখন এর মধ্যে যদি এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে করোনা সংক্রমণ গোপন করা হয় বা ওই অনুষ্ঠান থেকেই যদি করোনা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে হাসিনার পাশাপাশি মুজিবও জাতীয় শত্রু হিসেবেই আজীবন চিহ্নিত হবেন।