সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অবস্থান খোলাখুলি বোঝা গেলেও এ যুদ্ধের অপর পক্ষ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান এতদিন পরিষ্কার ছিল না। ইইউ যদিও মৌখিকভাবে সিরিয়ায় তুরস্কের হামলার বিরোধিতা করে আসছে, কিন্তু তুরস্কের সঙ্গে তাদের অংশীদারত্বও বেশ গভীর। তুরস্ক তাদের ন্যাটো মিত্র। ন্যাটোর জন্য তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্ক নিষ্ক্রিয় হলে ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বলয় হুমকিতে পড়বে।
অনেক দিন ধরেই ন্যাটো অঞ্চলের আকাশ সীমানায় নজরদারি বাড়ানোর জন্য তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে জার্মানির বিমান বাহিনী। অন্যদিকে ইইউ’র প্রধান শক্তি জার্মানি ও তুরস্কের নেতৃত্বের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অসহনীয় দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ববাসী। কারণ এরদোগান শরণার্থী কার্ড দিয়ে ইউরোপকে প্রবলভাবে উত্যক্ত করেছেন। ফলে ইউরোপ পড়েছে মহা ফ্যাঁসাদে। এ অবস্থায় তুরস্কের শরণার্থী কার্ডকে অকার্যকর করে ফেলার লক্ষ্য নিয়ে সিরিয়ায় তারা এক কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছে।
তুরস্ক যদি তার শরণার্থীদের দূরে কোথাও সরিয়ে না নেয়, তাহলে সব সময়ই ইউরোপ একটা বিপদের সম্মুখে থাকে। সেটা হলো, যেকোনো সংকটজনক পরিস্থিতিতে এই শরণার্থীদের ইউরোপের দিকে লেলিয়ে দেয়া হবে বা তারা এদিকেই ছুটে আসবে। ফলে সিরিয়ায় শরণার্থী সরিয়ে নেয়াটা চুড়ান্ত বিচারে ইউরোপের জন্য স্বস্তিদায়ক। রাশিয়া এক্ষেত্রে তুরস্ককে সহযোগিতা করে বাশার আল আসাদকে মানাতে পারলে সেটা সবদিক থেকেই লাভজনক হয়। তুর্কী ঝুঁকি মোকাবিলায় ইউরোপ কখনো রাশিয়ার সাহায্য চাইবে, এটা ভাবা কঠিন। তবে রাশিয়া কঠোর অবস্থান নিলে তুরস্কের পক্ষে সিরিয়ার সীমান্তে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এদিক থেকে হিসেব করে রাশিয়ার সমস্ত উদ্যোগেই জার্মানি সমর্থন দিচ্ছে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তুরস্ক ও রাশিয়াকে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন করার সুপারিশ দিয়েছেন জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাম্প কারেনবাউয়ার। বলা হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হবে সন্ত্রাস এবং ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে আবারও লড়াই শুরু করা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে যা সেখানকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন আবারও নিশ্চিত করবে এবং যারা বিতাড়িত হয়েছে তারাও স্বেচ্ছায় ফিরে আসতে পারবে।’
সুপারিশটি সম্পর্কে জার্মানি চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল অবগত আছেন বলেও জানান দেশটির ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের এই নেতা। তবে যেকোন সিদ্ধান্তই জার্মান মন্ত্রীসভা এবং সংসদ বুন্ডেসটাগের মাধ্যমে নেয়া হবে বলেও নিশ্চিত করেন তিনি। কারেনবাউয়ার বলেন, ‘ইউরোপ এখানে শুধু দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারে না৷ আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের সুপারিশ ও পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’
গত ৯ অক্টোবর সিরিয়ার উত্তর পূর্বের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহীদের দমনে অভিযান শুরু করে তুরস্ক। এর ফলে সেখানে বন্দী ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জার্মানি ও ইউরোপ। কারেনবাউয়ার বলেন, উত্তরপূর্ব সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ইউরোপ এবং জার্মানির নিরাপত্তা স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। যে কারণে এই বিষয়ে ইউরোপের একটি শক্ত পদক্ষেপ জরুরি। তিনি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অঞ্চল গঠনের আলোচনায় তুরস্ক ও রাশিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। বলেন, কেউ পছন্দ করুক আর না করুক সিরিয়ায় রাশিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ। এজন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে সিরিয়া সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হতে পারে বলে জানান প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
জার্মানির এই পদক্ষেপ থেকে পরিস্কার যে, তারা তুরস্কের শরণার্থীদের সিরিয়ায় প্রত্যাবাসনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই কৌশল কার্যকর করতে পারলে একদিকে তুরস্কের উত্তেজনা কমানো সম্ভব, অন্যদিকে শরণার্থীদের ইউরোপে আসার বিপদ কমানো সম্ভব। বাড়তি লাভ হলো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করে নেয়া। এটা এক অর্থে তুরস্কের হামলাকে বৈধতা দেয়ারই নামান্তর।
অথচ এটা না করে, তুরস্ককে এই যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে অনেক বিকল্পই ছিল। সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ, আন্তর্জাতিক সমস্ত বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক কাঠামো থেকে তাদের বহিস্কার করা এবং অস্ত্র, প্রযুক্তিসহ যে কোনো ধরনের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু এসব পথকে প্রাধান্য না দিয়ে তারা বরং এরদোগানকে তোষণের পথই অনুসরণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এরদোগানের কাছে নত হওয়ায় তুর্কী প্রেসিডেন্ট এই সুযোগে স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের স্থান আরো শক্তিশালী করতে পারবেন। পারবেন তুর্কী জাতীয়তাবাদকে আরো চাঙা করতে। পরিকল্পনামাফিক এগোতে পারলে এর পাশাপাশি তার করায়ত্তে আসবে সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কী আধিপত্য সৃষ্টির আকাঙ্খাও বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবে। ইইউ, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের দর কষাকষির ক্ষমতাও বাড়বে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসার পথও পাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয়ের যে ধারা তৈরি হয়েছে, সেটাকে হয়তো রুখে দেয়া সম্ভব হবে। দেখা যাচ্ছে, এরদোগান কুর্দিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সব দিক থেকেই লাভবান হলেন।