মিথ হল মানব সভ্যতার চিন্তা জগতের অন্যতম অনুষঙ্গ। মানুষ নিজে বাঁচার তাগিদে এবং স্বীয় কল্পনাকে প্রসারিত করতে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য মিথের। নিয়ানডার্থালরা সর্বপ্রথম আত্নার ধারণা নিয়ে আসে। সেখান থেকেই মিথের শুরু বলা যায়। তবে পরবর্তীতে ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ও চরিত্রের সাথে কল্পনার মিশেল মিথকে করেছে সমৃদ্ধ। মিথ শব্দটি এসেছে গ্রীক Muthos থেকে। শব্দটির অর্থ হল anything uttered by a word of mouth. মুখ হতে নিঃসারিত শব্দ দ্বারা উচ্চারিত কোন কিছু। প্লেটো muthos শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন কিছু বোঝাতে যা বস্তুত সত্য বিবর্জিত আবার পুরোপুরি অসত্যও নয়। প্রাচীন রোমে Fabula বা Fabulae প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ কমেডি নাটক। আর এই Fabula -র সমগোত্রীয় ভাবায় মিথের কল্পকাহিনীর দিকটাই মুখ্য হয়ে ওঠে এক সময়। তবে পরবর্তীতে এই ভাবনার বদল ঘটে। এক সময় আধুনিকতাবাদ এবং পরে উত্তরাধুনিকতাবাদে স্থান পায় এই মিথ। অনেক পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালেই একটি সত্য লুকিয়ে থাকে। মূল ঘটনা এবং এর সাথে লৌকিক নানা কল্পনা, উপকথার মাধ্যমে গড়ে ওঠে এক একটি মিথ। অনেক সময় বাস্তব এবং মিথ একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই মানব কল্পনা প্রসারিত হয়। মিথে যেমন বাস্তব বিরোধিতা আছে, তেমনি এতে বাস্তবতাও প্রকট। লেভি ক্লদ স্ট্রস তার ‘স্ট্রাকচারাল এনথ্রপলজি ‘ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় মিথ মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। এবং এটি মানব মনের একটি মৌলিক প্রবনতা যার সূচনা দেখা যায় আদি যুগে। প্রাচীন ধর্ম ভিত্তিক ইতিহাসে মিথকে কেবল অদৃশ্য শক্তির বর্ননায়ই ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাকৃতিক ঘটনা এবং প্রানীর জন্ম – মৃত্যু রহস্যের ব্যাখ্যার সন্ধান করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা নানা কল্পিত পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে যেখানে যুক্তির চেয়ে ধারণা ও বিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছে। এদিক দিয়ে প্রাচীন গ্রিসের মিথলজিই সবচেয়ে বিশদ, ব্যাপক এবং স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ। কিন্তু গ্রিসে মিথের শক্তি ও প্রভাব দুর্বল হয়ে আসে যুক্তিনির্ভর দার্শনিক আলোচনার অগ্রগতির সাথে প্যাগান ধর্মের ক্ষয় শুরু হওয়ায়। কিন্তু প্যাগান ধর্মের খানিকটা টিকে যাওয়ায় তার সাথে সংশ্লিষ্ট মিথের অবশিষ্ট অংশ থেকে যায়। ঐতিহ্যের সাথেও মিথের জোরালো সম্পর্ক বিদ্যমান। মিথ নিয়ে নৃতত্ত্ববিদরাই বেশি আলোচনা করেছেন কেননা একটা নৃগোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের সামাজিক আচার আচরণ, রীতিনীতি এবং সাংস্কৃতিক জীবনের বর্ননা দেওয়ার জন্য এর প্রয়োজন আছে। এই কাজে মিথ যে বেশ সহায়ক তা প্রমাণিত হয়েছে। সাহিত্য শিল্পের চর্চায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ সবকিছুরই প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্য ‘ গ্রন্থের ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘নিজের মুখের কথা বলতে গিয়েও কবি – সাহিত্যিকরা প্রাচীন কথা ও কাহিনীর আশ্রয় নেন। ‘বুদ্ধদেব বসুর মতে, মিথের আসল রূপ বিবর্তিত হলেও একই বীজ থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে বহু ফুল ফোটায়, অনেক ভিন্ন ভিন্ন ফল ফলিয়ে তোলে। (বুদ্ধদেব বসু, মহাভারতের কথা
সমাজে যখন ধর্মের প্রভাব অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল, তখন মিথই ধর্মের ভূমিকা পালন করেছে। তার মধ্যে একদিকে আধ্যাত্মিকতা যেমন ছিল তেমন দার্শনিকতাও ছিল। তবে নিকট অতীতে মাঝে মাঝেই মিথের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে, কেননা আধুনিকতার মাপকাঠিতে তার স্থান নেই বলে মনে করেছেন আধুনিকতার প্রবক্তারা। তবে কেউ কেউ তার বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন। এলিয়ট ছিলেন একজন মিথ সমর্থক কবি। তার ‘দি ওয়েস্টল্যান্ড ‘ কাব্যগ্রন্থে তিনি খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সম্পর্কিত মিথ ব্যবহারেই ক্ষান্ত হন নি। মিথের সমর্থনে প্রবন্ধও লিখেছেন। নর্থব্রুক ফ্রাই এর মতে, বাস্তবতা বলে আপাত দৃষ্টিতে যা মনে হয় তার নিচেই রয়েছে মিথের উপস্থিতি। যুগে যুগে মিথের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে জানার অসীম আগ্রহ। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে জ্ঞাতে -অজ্ঞাতে মানুষ তৈরি করেছে একের পর এক মিথ। যার কোনটা একেবারেই কাল্পনিক আবার কোনটাতে আছে বাস্তব কাহিনীর সংমিশ্রণ। ‘মিথের মৃত্যু হয়েছে ‘ একথা খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র বিশারদ বুল্টম্যান এবং কবি ফিলিপ লার্কিন বললেও মিথের বিনাশ নেই। আসলে তার ক্ষয়ও নেই। কেননা মিথ মাঝে মাঝেই রূপান্তরের মাধ্যমে নতুনভাবে আবির্ভূত হয় যেমন হয়েছে উত্তরাধুনিক শিল্প চিন্তায়। যুক্তি এবং কল্পনা যে মাপকাঠিতেই মিথকে বিচার করা হোক না কেন এর উপস্থিতি এবং বাস্তব প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশীলতার নিদর্শন হচ্ছে মিথ। এর শিল্প মূল্য অনেক। মিথের ভবিষ্যৎ পরিনতি কি তা সময়ের বিচার। কিন্তু ধাপে ধাপে সভ্যতার যে বিকাশ এবং উৎকর্ষ তাতে মিথের ভূমিকা অনেক। মিথের উপর দাড়িয়ে আমরা স্বীয় ইতিহাস – ঐতিহ্যের স্বরূপ চিনতে পারি। এগিয়ে যেতে পারি শিল্পের নান্দনিক উৎকর্ষে। সংস্কৃতিকে দিত পারি নতুন মাত্রা।
মিথের ব্যাপারটা এখনো ধুলায়
:থাম্বসআপ: মিথের ব্যাপারটা এখনো ধুলায় আবৃত
মিথগুলো কিন্তু অনেক কাজে
মিথগুলো কিন্তু অনেক কাজে লাগে।