সার্জারিতে ইন্টার্নশিপ চলছে। একদিন এডমিশন ডিউটি করছি সন্ধ্যাবেলা। এডমিশন ডিউটি বলতে বুঝায় ঐদিন হাসপাতালে যত সার্জারি রোগী ভর্তি হবে সব আসবে আমার ইউনিটে।
এক রোগী আসল চিৎকার করতে করতে। সাথে আরও তিনজন লোক স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। পরীক্ষা করে বুঝলাম ডিউডেনাল আলসার পারফোরেশন(অতিরিক্ত এসিডিটিতে খাদ্যনালী ফুটো) হয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা এটা ভয়াবহ সমস্যা। তাড়াতাড়ি স্যালাইন, ঔষধের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা শুরু করা হল। আমার প্রাথমিক কাজ রোগীকে অপারেশনের জন্যে প্রস্তুত করা।
সার্জারিতে ইন্টার্নশিপ চলছে। একদিন এডমিশন ডিউটি করছি সন্ধ্যাবেলা। এডমিশন ডিউটি বলতে বুঝায় ঐদিন হাসপাতালে যত সার্জারি রোগী ভর্তি হবে সব আসবে আমার ইউনিটে।
এক রোগী আসল চিৎকার করতে করতে। সাথে আরও তিনজন লোক স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। পরীক্ষা করে বুঝলাম ডিউডেনাল আলসার পারফোরেশন(অতিরিক্ত এসিডিটিতে খাদ্যনালী ফুটো) হয়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা এটা ভয়াবহ সমস্যা। তাড়াতাড়ি স্যালাইন, ঔষধের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা শুরু করা হল। আমার প্রাথমিক কাজ রোগীকে অপারেশনের জন্যে প্রস্তুত করা।
দুই ঘণ্টা পরের দৃশ্য। অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে আছি। একজন আই.এম.ও(দলনেতা) আরেকজন এইচ.এম.ও এবং আমি। রোগীর পেট কাটা হল। পেটকে অনেক সার্জন আদর করে বলে ম্যাজিক বক্স। বক্সের ভিতরে আসলেই ম্যাজিক দেখা গেল। খাদ্যনালী ছেড়ে বেরিয়ে এসে পুরো পেটের ভিতর জুড়ে বিরাজ করছে সবুজ শাকসবজি, কতিপয় ভাতের দানা। সার্জন দ্রুততার সাথে নাড়িভুঁড়ি ঘাঁটতে লাগলেন। মিনিট খানেকের মাথায় ফুটো আবিষ্কার করা গেল। লিভারের কাছটা দেখিয়ে সার্জন আমাকে বললেন হাত দে। আমি আস্তে আস্তে হাত দিলাম।
“আরে বেটা ডরাস নাকি? ভাল করে হাত দে। এইটা লিভার, হাত বুলা; ফিল কর। হ্যাঁ এইভাবে। সব অর্গান টাচ করে ফিল কর। সার্জনের হাত কোটি টাকার হাত। এই হাত পাকাইতে হবে। দুইদিন পর আমার জায়গায় আসবি তখন যেন কোন ভুল না হয়”।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম কথাগুলো। কত আত্মবিশ্বাস আর সাহসের সাথে বলা! অথচ এই লোকটা এখনো পুরো সার্জন হয়ে ওঠেননি। এফসিপিএস পাশ করার অপেক্ষায় আছেন।
এই গল্প বাংলাদেশের একজন উঠতি সার্জনের গল্প। যার কাছে একটা Duodenal Ulcer Perforation অপারেশন করা ডাল-ভাত। মূল সার্জারি অধ্যাপকদের কথা কি বলব আর? বলতে গেলে আরব্য রজনীর শেষ রাতও পেড়িয়ে যাবে তাদের প্রতিভা আর অসাধারণত্বের গল্প বলে শেষ করা যাবেনা। একটা অপারেশন থিয়েটার যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় ধরনের অভাব অনটন সেখানে ঐ সীমিত রিসোর্সের ভিতর থেকেই তারা কি অবলীলায় অসাধারণ সব অপারেশন করে যাচ্ছেন রোজ। স্ট্রেচারে করে কাঁদতে কাঁদতে আসা রোগী কিছুদিন পর পায়ে হেঁটে হাসতে হাসতে বাড়ি যাচ্ছে।
ইন্দিরা গান্ধি মেমোরিয়াল হাসপাতাল, মালদ্বীপ। ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে এক রোগী এসেছে আমি ভাগ্যক্রমে আশেপাশেই ছিলাম। ভারত থেকে ইম্পোর্টেড সার্জন মশাই আমাকে ডাকলেন বহুভাষাবিদ হিসেবে। বাংলাদেশী রোগীর কথা তার কাছে ইংরেজি অনুবাদ করে দিতে হবে। এদিকে আমার মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের স্যারও এসে হাজির।
জানলাম এতক্ষণে সার্জারি টিম রোগী দেখে ফেলেছে। তাদের অভিমত হল এটা মেডিসিনের কেস, সার্জারি রিলেটেড কিছু না। আমি রোগীর সাথে কথাবার্তা বললাম, পেটটা একটু পরীক্ষা করলাম। আমার সুবিধা ছিল আমি রোগীর পুরো সমস্যার কথা আদ্যপ্রান্ত বুঝতে পেরেছিলাম।
Sir! I think this is a case of D.U Perforation.
আশেপাশের সবাই আমার দিকে চোখ বড় করে তাকাল। ভাবখানা এইরকম “হাতি ঘোড়া গেল তল, ইদ্রিস বলে কত জল?’’
তারা রোগীকে অবজার্ভেসনে রেখে চলে গেল। পরদিন সকালে ডিউটিতে গিয়ে শুনি মাঝরাতে সেই রোগীর ইমার্জেন্সি অপারেশন করা হয়েছে। পেট কেটে দেখা গেছে খাদ্যনালীতে ফুটো।
আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বুকের ভিতরের দীর্ঘশ্বাসটাকে চাপা দিলাম। কারন এই বেচারা রোগীটা যে আমার দেশের মানুষ! আহারে সারারাত মানুষটা কত যন্ত্রণায়ই না ভুগেছে!
প্রায় এক সপ্তা কেটে গেছে। আজকে সার্জারি ডিপার্টমেন্টের হেড আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম রোগীর সাথের লোকজন তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। আমি যেন তাদের সাথে একটু কথা বলি এই ব্যাপারে।
রোগীর ছেলে কাছেই ছিল। জানতে পারলাম বাপ ছেলে একসাথে এখানে আছে বছর পাঁচেক ধরে।
ভালই কাটছিল দিনকাল হঠাৎ করে বাবার এই অসুস্থতা সব এলোমেলো করে দিল। আরও জানা গেল এরমাঝে সার্জন রোগীর পেট দ্বিতীয়বার কেটেছে কারন আগেরবারের সেলাই নাকি খুলে গেছে! এখানেই শেষ নয়… তিনি তৃতীয়বারের মতো অপারেশন করতে চান! কারন সমস্যা এখনো ঠিক হয়নি! ছেলেটা আর এখানে থাকতে রাজিনা। দেশে ফিরে গিয়ে চিকিৎসা করাবে।
এরমাঝে হাসপাতালের বিল এসেছে দেড় লক্ষ টাকা। রোগীকে বিমানে করে নিয়ে যেতে খরচ লাগবে আরও দেড় লক্ষ টাকা। ছেলেটার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিলনা এই কথাগুলো শোনার পর। এখনো যে এই ছেলে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই অবাক করা বিষয়। পেরেছে হয়তো সে বাঙ্গালী বলেই। এখনো নানা জায়গায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে… একবার অ্যাম্বাসি আরেকবার এয়ারলাইন অফিস আবার হাসপাতালের এই কাউন্টার থেকে ঐ কাউন্টার!
আপাত মামুলি একটা অপারেশন করতে গিয়ে রোগীটার পেট কাটা হয়েছে দুইবার, তৃতীয়বার কাটার পায়তারা চলছিল। দেড় লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছেলেটা কিছু পায়নি হাসপাতালের কাছ থেকে, কিছুই না। তার বাবার এক আনা উন্নতি হয়নি।
এই অপারেশনটা কোন অপারেশন বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ এটা সেই অপারেশন যেটা করতে গিয়ে একজন বাংলাদেশী শিক্ষানবিশ সার্জনের সময় লেগেছিল মাত্র আধঘণ্টা, যা করতে গিয়ে তাঁর হাত এক বিন্দু কাঁপে তো না-ই বরং আমার কাঁপা কাঁপা হাতটা টেনে নিয়ে শিখিয়েছিলেন কিভাবে অপারেশন করতে হয়।
পাঠকবন্ধুগণ এবারে বলুন তো আমার লেখার শুরুতে বলা সেই প্রথম রোগীটার অপারেশন করতে কত খরচ হয়েছিল? থাক কষ্ট করতে হবে না। আমি বলে দিচ্ছি “মাত্র দেড় হাজার” টাকা। কিছু স্যালাইন আর আনুষঙ্গিক ঔষধ কিনতে ওটা খরচ হয়েছিল।
এরপরও যারা দেশের চিকিৎসা মান নিয়ে নাক সিটকান আর ভারত-আম্রিকা নাম শুনে গলে-ঢলে পড়েন তাদেরকে বলব ওরকম নাক রাখারই প্রয়োজন দেখিনা। এই হাসপাতালে চলে আসেন, অপারেশন করে নাক কাটিয়ে যান। একবারে না হোক তিনবারে নিশ্চয়ই নাক কেটে দিতে পারবে আহাম্মকগুলো।
পড়ে অনেক অনেক ভাল লাগছে,
পড়ে অনেক অনেক ভাল লাগছে, ডাক্তার সাব!!
আমি জানি, আমার খুব কাছের কিছু মানুষ আছে যারা এই পেশায় শত অভিযোগ অনুযোগের পরও তাদের অকৃত্রিম আর ঐকান্তিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন গরীব দুঃস্থদের …
আপনাদের সালাম!! ভাল থাকবেন… :salute: :salute: :salute: :salute: :salute: :salute: :salute: :salute:
অনেক ধন্যবাদ ভাই অভিজ্ঞতা
অনেক ধন্যবাদ ভাই অভিজ্ঞতা শেয়ার করবার জন্য , সেই সাথে মাদের সকল সার্জেনদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা । আপনার কাছে এমন আরও অনেক অভিজ্ঞতা শুনতে চাই ।
আচ্ছা সেই লোকটার কি হল ? দেশে তার চিকিৎসার কি খবর ? তাকে কিভাবে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল । টাকা জোগাড় হয়েছিল ? জানতে ইচ্ছা করছে ।
সবশেষ দেশে আনার খবর পাওয়া
সবশেষ দেশে আনার খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে দেশে এই অপারেশন টাকার জন্যে আটকে থাকবে না। সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যাবার কথা।
আমাদের দেশের ডাক্তারদের
আমাদের দেশের ডাক্তারদের সম্পর্কে ভালো কিছু শুনতে এখনও আমরা অভ্যস্ত হইনি। মিডিয়া থেকে শুরু করে সবখানেই নেগেটিভ ভাবে উপস্থাপন করা হয়। ভাবটা এমন, এই দেশের ডাক্তাররা কিচ্ছু জানেনা, কসাই এক একটা। আর বিদেশী ডাক্তাররা সব সবজান্তা আর দানশীল হাজি মহসিন। চক্ষু বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি সরকারী চাকরীতে জয়েন করার আগে যেই প্রাইভেট চক্ষু হাসপাতালে কাজ করতাম ওরা বছরে একবার নরসিংদীতে একদিনের একটা ফ্রি ক্যাম্প করে। ঐ হাসপাতালের সাথে সিঙ্গাপুরের একটা আই হসপিটালের সহযোগিতা চুক্তি ছিল। সেই চুক্তির আওতায় কয়েকজন সিঙ্গাপুরি চক্ষু বিসেশজ্ঞ আসতেন প্রতি বছর। একবার আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ঐ ক্যাম্পে। সিঙ্গাপুরি চক্ষু বিশেষজ্ঞের অপারেশন দেখার লোভ কাজ করেছিলো কিছুটা। কিন্তু অপারেশন দেখে পুরাই স্পীকার হয়ে গেলাম। এক একটা ছানি অপারেশন করতে টাইম নেয় ১ ঘণ্টার উপরে, তাও অপারেটিং স্কিল আমাদের ঐ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের চেয়ে অনেক খারাপ। সবার উদ্দেশ্যে বলি, ডাক্তাররা কখনই কোন রোগীর খারাপ চায় না। ব্যতিক্রম আছে, থাকবেই। কিন্তু জেনারালি সব ডাক্তার খারাপ না। তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা টিকে থাকত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার এনুয়াল রিপোর্ট যদি দেখেন, দেখবেন বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার সার্বিক অবস্থা অনেক পজিটিভ। একটু আস্থা রাখুন, আর ভণ্ড কিংবা অসৎ ডাক্তার পেলে তার বিরুদ্ধে সঠিক পন্থায় ব্যবস্থা নিন। দেখবেন আমাদের দেশের দাক্তাররাই বিশ্ব মানের চিকিৎসা সেবা দিতে সক্ষম। দিন বদলেছে। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকরা এখন অনেক বেশী সচেতন তাদের প্রফেশন নিয়ে। আমি আশাবাদী।
চিকিৎসক সমাচারকে ধন্যবাদ ইস্টিশনে লেখার জন্য। নিয়মিত চাই। ডাক্তারদের ঢোল তো কেউ পেটায় না, আমরা নিজেরাই খানিক পেটাই আসেন। 😀
আতিক ভাই আমার বাবা’র ছানি
আতিক ভাই আমার বাবা’র ছানি অপারেশন হইছিল NIO তে। তখন সেটা ছিল সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের সাথে পাশেই লাগানো। ওটির বাহিরে একটা বড় টিভি ছিল। সেদিন দেখলাম একেকটা ফ্যাকো ইমালসিফিকেশন করতে সময় লাগছিল বড় জোড় ১৫-১৭ মিনিট। একদিনে প্রায় ৩০-৪০ জনের ফ্যাকো করল সেদিন এক স্যারই।
আমাদের উচিত দেশীয় চিকিৎসার
আমাদের উচিত দেশীয় চিকিৎসার উপর আস্থা রেখে একে আরও বেশি আধুনিকায়নের উপর মনোযোগ দেয়া ।।
(No subject)
:থাম্বসআপ: :থাম্বসআপ: