“আব্বু প্লিজ! এর মধ্যে আবার সিগারেট ধরিয়েন না তো। দমবন্ধ হয়ে আসে!”
সামনের সিট থেকে কথাটা বললো রায়হান।তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। ছোট ছেলের উদ্দেশ্যে মঞ্জু সাহেব বললেন, “আহহা! পাশের জানালা খুলে দে! বাতাস ঢুকবে। এতে গুমোটভাবটাও কমবে। দে! জানালা খুলে দে!”
মঞ্জু সাহেবের পাশ থেকে তার স্ত্রী নড়েচড়ে বলে উঠলেন, “আমার ঠান্ডা লেগেছে তা তো নিশ্চয়ই তোমার মনে নেই, না? এই মাঝ রাত্তিরে জানালা খুললে ভেতরে যে ঠান্ডা বাতাস ঢুকবে আর তাতে যে আমার শরীর আরো খারাপ হবে সেটাও নিশ্চয়ই ভুলে বসে আছো, রাইট?”
“আব্বু প্লিজ! এর মধ্যে আবার সিগারেট ধরিয়েন না তো। দমবন্ধ হয়ে আসে!”
সামনের সিট থেকে কথাটা বললো রায়হান।তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। ছোট ছেলের উদ্দেশ্যে মঞ্জু সাহেব বললেন, “আহহা! পাশের জানালা খুলে দে! বাতাস ঢুকবে। এতে গুমোটভাবটাও কমবে। দে! জানালা খুলে দে!”
মঞ্জু সাহেবের পাশ থেকে তার স্ত্রী নড়েচড়ে বলে উঠলেন, “আমার ঠান্ডা লেগেছে তা তো নিশ্চয়ই তোমার মনে নেই, না? এই মাঝ রাত্তিরে জানালা খুললে ভেতরে যে ঠান্ডা বাতাস ঢুকবে আর তাতে যে আমার শরীর আরো খারাপ হবে সেটাও নিশ্চয়ই ভুলে বসে আছো, রাইট?”
মঞ্জু সাহেব সাহেব বুঝতে পারলেন তার স্ত্রী ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিগারেট নিভিয়ে ফেলে তিনি চুপচাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা বড় ছেলে চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। মঞ্জু সাহেব তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রাফি! কষ্ট হলে দে আমি চালাই! অনেক্ষণ হয়ে গেছে!” ছেলের এক কথায় উত্তর, “লাগবেনা বাবা!পারছি তো।”
তিনি জানতেন রাফসান এই উত্তরটাই দেবে।তাও জিজ্ঞেস করেন। ছেলেকে বোঝানো যে তিনি পাশে আছেন; তার কোন চিন্তা নেই! ছেলেটা সব কাজ বড় দায়িত্ব নিয়ে করে। ছোট ছেলেটার দিকে একবার তাকান তিনি। একমনে ট্যাবে বই পড়ছে। ট্যাব থেকে সাদা আলো তার মুখে পড়ছে। সেই আলোতে দেখলেন ছেলের ঠোঁটের কোণে হাসি। নিশ্চয়ই কোন মজার বই হবে!
সাঁই সাঁই করে ছুঁটে চলা গাড়ীটিতে তখন নিরবতা।
তাদের যাত্রাপথ চিটাগাং টু ঢাকা। সময়রাত ৩টা ২১। বাহন এর নাম টয়োটা রাশ। মঞ্জু সাহেব এর এই গাড়িটা বেশি পছন্দ। বড় ছেলে ড্রাইভিং করতে পছন্দ করে। তিনি বারণ করেন না। লাইসেন্স করে দিয়েছেন দুই ছেলেরই।রাফসান চমৎকার গাড়ি চালায় বলে তিনি তার এই পছন্দের গাড়িতে ড্রাইভার ইউজ করেননা। পরিবারের সাথে একান্তে কাটানো সময়ে বাইরের লোক থাকুক সেটা তিনি পছন্দ করেন না। পুরো পরিবার নিয়ে মাঝে মাঝেই লং ড্রাইভে বের হন। অতীত জীবনটা ব্যয় করেছেন টাকার পেছনে। সফল হয়েছেন। টাকার সাথে বোনাস হিসেবে পেয়েছেন ক্ষমতা। এখন পরিবার নিয়ে সুখে বাকি জীবন কাটাতে চান।
“বাবা এই জায়গা থেকে একটু দেখে চালা। বাঁক একটু বেশিই!” – বললেন মঞ্জু সাহেব। “হুম বাবা!দেখছি।”, ঝটপট উত্তর রাফসানের।
মঞ্জু সাহেব একটু ভাবলেন, বড় ছেলেটা এইরকম কম কথা কেন বলে তাদের সাথে! রায়হানের সাথে তো তার দিব্যি সখ্যতা। সারাদিন দুইজন বকবক করছে যখনই সময় পাচ্ছে। কিন্তু তার সাথে কিংবা ওর মায়ের সাথে এতো কম কথাবলে কেন!
মঞ্জু সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর খেয়াল করলেন ইদানিং তিনি একটু বেশিই করছেন এই কাজটা। তার জীবনে কি কিছুর অপূর্ণতা আছে? হয়তো আছে। তিনি সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাননা!
তখন রায়হান একটু হেসে উঠলো। বললো, “শোন ভাইয়া এইখানে কি বলছে! সফদর আলী জানতো না যে গাছ আলোর দিকে বৃদ্ধি পায়! নিজে নিজে সেইটা আবিষ্কার করে তারপর ভাবছে ভাবছে মহা-কিছু করে ফেলছে! হেহেহে!!”
রাফসান বললো, “ও! ঐটা পড়তেছিস! সেইরকম মজা বইটা! আরেকটু পরে দেখবি কি মজা হয়! পীর সাহেবের ব্যপারটা!…”
রাফসান মহা-উৎসাহে পীর সাহেবের বেকায়দায় পড়ার ঘটনা বলতে থাকলো! শায়লা বললেন, “ঐ তোরা কথা বলিস না! দেখে চালা!”
রাফসান হেসে বললো, “মা! আমি চোখ দিয়ে কথা বলি না! মুখ দিয়ে বলি। চিন্তা করোনা তো!”
শায়লা চুপ করে গেলেন। তিনি জানেন ও দেখেই চালাবে। শুনলেন তার দুই ছেলে এক ভণ্ড পীরের দুরবস্থার কথা আলোচনা করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
একটু পরে রায়হান হাসতে হাসতে বললো, “উফ! ভাইয়া! সব আগে থেকে বলে দিও না তো! পরে মজা পাবোনা!”
রাফসান তার দিকে হেসে বললো, “আরে আমার মতো বর্ননা কি আর জাফর ইকবাল…”
হঠাৎ পেছনের সিটে বসা মঞ্জু সাহেব এবং শায়লা দুইজনই একসাথে দেখতে পেলেন সামনে একটা হাই-ওয়ে বাস আর একটা ৫টনের ট্রাকপ্রতিযোগিতা করতে করতে ছুটে আসছে। ট্রাকের গায়ে লেখা সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন…
তার আতংকে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল! তিনি শুনছেন রাফসান বলছে, “…ই-ক-বা-ল দি-তে পা-রে ? এ-ইগ-ল্প-টা আ-মি……”
রাফসান যেন অনেক সময় নিয়ে অনন্ত কালধরে বলে চলেছে…বলেই চলেছে!
তিনি যেন অনন্তকাল ধরে শুনছেন…শুনছেন…শুনেই যাচ্ছেন! তার মনে হতে লাগলো আশেপাশের সবকিছু হঠাৎ থেমে গিয়েছে। শুধু যমদূতের মতো দুইটা ভয়ংকর প্রাণী একসাথে এগিয়ে আসছে পালাবার কোন পথ না রেখে!
আসছে…আসছে…!
রাফসানের চোখ রায়হানের দিকে! রায়হান হেসেই চলেছে! কি উজ্জ্বল-উচ্ছল সেই হাসি!
মঞ্জু সাহেব ভাবছেন…এই সুখী-সুন্দর পরিবারটা কি এখনই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে?
তার ঝগড়াটে বৌটাও কি একটু পর মরে যাবে?
তার রায়হান, যার দিকে ভার্সিটির সিনিওর আপুরা পর্যন্ত হা করে তাকিয়ে থাকে; সেই দেবদূতের মতো সুন্দর ছেলেটাও কি মরে যাবে?
তার বুয়েটের ভর্তি-পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে অ্যাডমিশন নেয়া রাফসান…
হঠাৎ শায়লা চিলের মতো চিৎকার করে উঠলেন, “রা—ফি-ই-ই!!!!”
মায়ের চিৎকার শুনে রাফসান চমকে পিছনে তাকালো। শায়লার শরীরে কিছু একটার তীব্র হলুদ আলো পড়েছে। হঠাতই রাফসান বুঝতে পারলো সেটা হেডলাইটের আলো। হঠাতই তীব্র হাইড্রলিক হর্ন এর শব্দ শুনতে পেল সবাই; রাফসানও! সে বুঝে গেলো কি হতে চলেছে!
সে দেখলো আর ২০ ফিট দূরেও নেই ট্রাকটা। তার পাশেই হাই-ওয়ে বাস! তীব্র গতীতে এগিয়ে আসছে ভয়ানক দানবের মতো! রাফসান দিগ্বিদিক-শুন্য হয়ে স্টিয়ারিং হুইলটা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে যথাসম্ভব বামে ঘুরিয়ে দিলো। চাইছে রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা পাশের বিশাল খাদে নিয়ে ফেলতে। অ্যাকসিডেন্ট থেকে বাঁচার জন্য এই উপায়টাই তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় আসে রাফসানের।
গাড়িটা তখন রাস্তার ওপর প্রায় ৯০ডিগ্রি ঘুরে গেছে সাঁই করে। গাড়ি তখনও রাস্তা ছেড়ে নামতে পারেনি।রায়হান এক হাতে শক্ত করে তার ট্যাবটা ধরে রেখে অন্য হাতটা সিটবেল্টে ধরে অপলক বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো ট্রাকটার হেডলাইটের দিকে। ভয়ানক দুটি চোখ প্রচন্ড আক্রোশে এগিয়ে আসছে যেন!
পেছনে শায়লা প্রথম টের পেল যে সত্যিই রক্ষা পাওয়া সম্ভব না! মঞ্জু সাহেবের হাতটা আঁকড়ে ধরে শায়লা আতঙ্কে চোখটাও বন্ধ করার সময় পেলেন না। বাসটা তীব্র গতিতে এসে আঘাত করলো গাড়িটার পেছনের দিকে। গাড়িটার পেছনের দিকটা প্রচন্ড আঘাতে ঘুরে রাস্তায় আবার সোজা হয়ে গেলো। আর তার ঠিকপর মুহূর্তেই ট্রাকটা গাড়িটার মুখোমুখি আঘাত করলো সরাসরি।
রাফসান যখন চোখটা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাচ্ছে তখন ট্রাকটা উইন্ডশিল্ড এর উপরে উঠেউইন্ডশিল্ড ভেঙে তার দানবিক চাকাগুলো তাদের ওপর উঠিয়ে দিয়েছে…রাফসান শেষ মুহূর্তে শুনতে পেল রায়হান ভাঙা গলায় অস্ফুট স্বরে বলছে, “ভাইয়া…!”
_____________________________________________________________________________
ট্রাকচালক হতভম্ব হয়ে বসে আছে স্টিয়ারিং ধরে। পাশে বসে আছে হেল্পার। তার চোখ আতঙ্কে বন্ধ হয়ে কুঁচকে আছে। তারকপালে জমাট বাঁধা রক্ত। খুব সম্ভবত ধাক্কার কারণে ট্রাকের উইন্ডশিল্ডের ওপর আছড়ে পড়েছিলো সে।
বাসটাও থেমে আছে পাশে। যাত্রীদের চেঁচামেচি বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। শুনতে পেল ট্রাকচালক আজিজও। সে গলা বের করে বাসচালককে একটা গালি দিতে যাবে তখনই বাসটা আস্তে করে স্টার্ট নিয়ে চলে গেলো। আজিজ হতাশ মুখে অদৃশ্য একজনকে খুব খারাপ ভাষায় একটা গালি দিল। আজিজ অ্যাকসিডেন্ট করার কারনে হতাশ নাকি বাসচালককে গালি দিতে না পারার কারণে হতাশ তা ঠিক বোধগম্য না।
পাশ থেকে হেল্পার চাপা গলায় বলে উঠলো, “লন ওস্তাদ! যা হওনের হইছে। এহন মেলা হরেন। খাড়ায়া থাকলে ঝামেলা হইত্যারে।” আজিজ তার কথায় সায় দিয়ে পিচিক করে পানের পিক ফেললো বাইরে।
তারপর ব্যাক গিয়ার দিয়ে সামনের দুইচাকার নিচে পড়ে থাকা গাড়িটার ওপর থেকে পেছনদিকে সরে গেলো। তারপর পাশ কাটিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো।
কিছুদূর যাওয়ার পরে আজিজ আবার কাকে যেন গালি দিয়ে বললো, “ধুর! চাক্কা কিসে যেন বাজত্যাছে। বডি মনে কয় ভচকায় গেছে। ওস্তাদ খাইয়ালাইবো রে এক্কেরে!” তার কপালের ভাঁজ আর মুখ দেখেই বোঝা গেলো ওস্তাদের “খাইয়ালানো” আসলেই ভয়ানক কিছু।
_____________________________________________________________________________
মঞ্জু সাহেবের জ্ঞান ফিরে আসলো একটু পরে। তিনি কিছুক্ষন নিঃশ্বাস ফেলে বুঝলেন তিনি বেঁচে আছেন। তার গায়ের ওপর নিথর পড়ে আছে শায়লা। তিনি হাতটায় ভর দিয়ে একটু উঁচু হওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি তখন দেখলেন তিন-চার জন লোক জানালা দিয়ে উঁকি মারছে। তিনি অন্য হাতটা শায়লার শরীরের নিচ থেকে টেনে বের করতে গিয়ে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলেন। তখন বাইরে থেকে উঁকি মারা লোকদের একজন উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলো, “দোস্ত! মনে হয় বেঁচে আছে!” বাইরে থেকে একজন বললো, “চাচা! দরজার লকটা একটু খুলে দেন কষ্ট করে! আমরা বের করে নিয়ে যাবো আপনাদের! প্লিজ একটু কষ্ট করেন!” মঞ্জু সাহেব তখন বাঁচার আশায় বুক বাঁধলেন। প্রচন্ড পরিশ্রম করে তিনি শায়লাকে সরিয়ে মুক্ত হতে পারলেন। এবং তখন বুঝলেন যে শায়লাও বেঁচে আছে এবং মঞ্জু সাহেবের বাম হাত ভেঙে গেছে। তিনি লক খুলে দিলেন।
বাইরে থেকে দুইটা মানুষ এসে মঞ্জু সাহেবকে ধরে বের করলো। তিনি দেখলেন যে পাশে একটা বারো সিটের মাইক্রো বাস দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়ে শুইয়ে দিলো একটা সিটে।
মঞ্জু সাহেব তখন আস্ফুট স্বরে বলারচেষ্টা করলেন, “আমার স্ত্রী বেঁচে আছে! তাকে বের করেন! আর সামনের দুই সিটে আমার দুই ছেলে কেমন আছে?”
ক্রিকেট ক্যাপ পরা ছেলেটা কপালের ঘাম মুছে হালকা হেসে বলল, “চাচা সবাইকে বের করব! ইনশাল্লাহ কিছু হবেনা আপনাদের! আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন!”
তখন মঞ্জু সাহেব দেখলেন তার স্ত্রীকে ধরাধরি করে নিয়ে এসে রাখলো তার পেছনের সিটে। তখনো অজ্ঞান শায়লা।
তিনি তখন আবারও বললেন, “বাবারা! আমার রাহি আর রাফিকে একটু বের করো তোমরা!”
ক্যাপ পরা ছেলেটা তার হাত ধরে বললো, “চাচা! আপনি চিন্তা করেন না! আমরা আছি তো!”
মঞ্জু সাহেব তাদের ওপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজলেন।
“দোস্ত! রক্তে তো ভেসে যাচ্ছে রে! এতো রক্ত কিভাবে হলো?” আতঙ্কিত কণ্ঠ ভেসে আসলো সামনের সিটের পাশ থেকে। লম্বা চুলের ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “মনে হয় বেঁচে নাই রে! আঙ্কেলটা বারবার বলতেছিলো ছেলে দুইটারে নিয়ে আসার কথা। কি করি এখন?”
কালো শার্ট পরা ছেলেটা তাও একবার চেক করে দেখার জন্য রায়হানের ওপর ঝুঁকে পড়লো। একটু পরে তার জোরালো স্বর শোনা গেলো, “বেঁচে আছে রে এখনো! পালস পাইতেছি!”
লম্বা চুলের ছেলেটাও বললো, “এই ছেলেটারও পালস আছে! যা করতে হবে কুইক করতে হবে রে! একদম টাইম নাই! অবস্থা খুব খারাপ!”
“বের করবো কিভাবে রে? একদম চাপ খেয়ে পড়ে আছে যে! একটা হাড়ও মনে হয় আস্ত নাই!”- প্রচন্ড হতাশ কণ্ঠ ভেসে আসলো রায়হানের পাশ থেকে।
“টেনে-হিঁচড়ে বের করা ছাড়া গতি নাই! রেখে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যে এমনিতেই মারা যাবে!” বলে হাত লাগালো লম্বা চুলের ছেলেটা।
তাদের দুইজনের সাথে ক্যাপ পরা ছেলেটাও এসে হাত লাগালো। প্রথমে তারা বের করলো রাফসান কে। ধরাধরি করে নিয়ে গেলো তাদের মাইক্রো বাসের ভেতরে। দেখলো মঞ্জু সাহেব উঠে বসে আছেন। রাফসানকে শুইয়ে দেয়া হলো লম্বা সিটে। মঞ্জু সাহেব অনেকটা হতবিহ্বল। বললেন, “রাফি! রাফি কি মরে গেছে? রাহি? রাহি কোথায়? সেও কি মরে গেছে?”
“না আঙ্কেল! আনছি তাকেও! আপনি স্ট্রেস নিবেন না প্লিজ!” বললো একজন।
“একে কিভাবে বের করি বলতো? গাড়ি তো পুরো এর গায়ের ওপরই চেপে বসেছে!” ক্যাপ পরা ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
ভেতর থেকে লম্বা চুলের ছেলেটা বললো, “সিট শুইয়ে দেই! তারপর পেছন থেকে আস্তে আস্তে টান দিলে বের হবে না?”
“এ ছাড়া আর উপায়ও নাই রে!” সায় দিয়ে কাজে লেগে গেলো একজন। হাত লাগালো বাকি সবাই।
টেনে বের করেই বুঝলো সবাই- এর খুব বেশি সময় হাতে নেই।
“ওটা কি হাতে? মোবাইল?” প্রশ্ন করলোএকজন! “হুম!” এক কথায় সায় দিলো কালো শার্ট।
“রাহি কি বেঁচে আছে? বেঁচে আছে ও?” গাড়িস বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মঞ্জু সাহেব। মনে হয় তার শুধু হাত ভাঙা ছাড়া আর গুরুতর কিছু হয়নি।
“জ্বি আঙ্কেল! তবে এর অবস্থা বেশি ভালো না! আপনি চিন্তাকরেন না! কাছে একটা ছোট-খাট হসপিটাল আছে। এখন সেখানে যাবো।” বললো ক্যাপ পরা ছেলেটা। গিয়ে ড্রাইভিং সাইট বসলো সে।
মাইক্রো ছুটছে প্রবল বেগে।
শায়লার জ্ঞান ফিরে এসেছে। মঞ্জু সাহেব তার হাত ধরলেন। ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠলেন শায়লা।
মঞ্জু সাহেব তার স্ত্রীকে ফিসফিস করে বললেন, “শায়লা! আমরা সবাই বেঁচে আছি শায়লা। আমাদের কিছু হয়নি!”
শায়লা একবার “হু” বলে আবার চোখ বুঁজলেন।
মঞ্জু সাহেবের চোখ গেলো পেছনের দুই সিটে। শুয়ে আছে তার দুই সন্তান রায়হান আর রাফসান।
সারা শরীর দুইজনেরই রক্তে ভেজা। কোথাথেকে আসল এতো রক্ত? এরা কি সত্যিই বেঁচে আছে? আর কতোক্ষণ বেঁচে থাকবে?
মঞ্জু সাহেব বুঝতে পারলেন এখনো শেষ রক্ষা হয়নি। হয়ত হবেনা। এতো বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট দিয়ে বিধাতা এতো সহজেই কাউকে ছেড়ে দেন না।
মঞ্জু সাহেব আস্তে আস্তে শরীরে ব্যাথা অনুভব করছেন। বুঝছেন ব্যাথা বাড়বে খুব। লম্বা চুলের ছেলেটা রায়হান আর রাফসানের শরীরের রক্ত যতোটা পেরেছে মুছে দিয়েছে একটু আগে। ধরে রেখেছে তাদের শক্ত করে। আরো রক্ত কোথা থেকে এসে জানি আবার শরীরটা রক্তে ভরিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটা প্রচন্ড আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে নিথর পড়ে থাকা শরীর দুইটার দিকে।
“আঙ্কেল! আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় থাকেন? কিভাবে হলো এত সব?” জিজ্ঞেস করলো কালো শার্ট।
মঞ্জু সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি মঞ্জুরুর রহমান মঞ্জু। শায়লা গার্মেন্টস, শায়লা সিরামিকস, শায়লা জুয়েলারিজ, শায়লা বিল্ডারস, শায়লা ফার্মাসিটিউক্যালস…এই এইগুলোর মালিক।”
কালো শার্ট বিড়বিড় করে কি যেন বললো একটু; বোঝা গেলো না। পেছন থেকে লম্বা চুল বললো, “আঙ্কেল! আপনার তো অনেক ক্ষমতা! দেখেন না হেলিকপ্টারের ব্যাবস্থা করতে পারেন কিনা! নিশ্চয়ই পারবেন! ছেলে দুইটার অবস্থা বেশি ভালো না!”
নানা চিন্তায় আর শারীরিক কষ্টে মঞ্জু সাহেবের মাথা কাজ করছিলো না। তিনি এইবার পথ খুঁজে পেলেন যেন! “তাইতো!” বলে পকেট হাতড়াতে লাগলেন মোবাইলটা বের করার জন্য। মোবাইলটা বের করে সামনে নিয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মোবাইলের দিকে। তার স্ক্রীন সর্বস্ব মোবাইলের স্ক্রীনটা আর অবশিষ্ট নেই।
“বাবা! আমার মোবাইল তো ভেঙে গেছে! কাজ হবেনা বোধ হয়!” হাহাকার করে বলে উঠলেন মঞ্জু সাহেব। কার উদেশ্যে বললেন তা কেউ বুঝলো না। তাই উত্তরও দিলো না কেউ। শোনা গেলো শুধু দীর্ঘশ্বাস।
একটু পরে কালো শার্ট বললো, “আপনার কারো নাম্বার মনে নেই? আপনার সেক্রেটারি কিংবা আর কারো?”
মঞ্জু সাহেব তখন হাতে মাথা ভর দিয়ে নিচু হয়ে বসে ছিলেন। আস্তে করে উত্তর দিলেন “নাহ! বুড়ো বয়সে কি আর এতো মনে থাকে! নাম্বার মনে থাকতো রাফসানের। সে তো…!”
ক্যাপ পরা ছেলেটা বললো, “আঙ্কেল! সামনেই হসপিটাল! চিন্তা করেন না! আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন! আর বেশিক্ষণ বাকি নেই! ইনশাল্লাহ সবাই বেঁচে যাবেন! আল্লাহ এতো নিষ্ঠুর হবেন না!”
তার ঠিক দশ মিনিটের মাথায় গাড়ি একটা হসপিটালে পৌঁছালো। গাড়ি থেকে নেমেই কালো শার্ট দৌড়ে গেলো বিল্ডিং এর ভেতরে। ভেতরে ঢুকে দেখলো কিছু লোক ওয়েটিং রুম জাতীয় একটা জায়গায় বসে ঝিমাচ্ছে। সে চিৎকার করে বললো, “ডক্টর কোথায় পাবো বলতে পারেন? ইমার্জেন্সি ভাই! হাইলি ইমার্জেন্সি! অ্যাকসিডেন্ট করা লোক চারজন! ক্রিটিকাল অবস্থা!” একটা টেবিলের পাশে চেয়ারে অ্যাপ্রন পরা একজন নার্স টাইপ মেয়ে ঘুমাচ্ছিলো। সে লাফিয়ে উঠে চোখ কচলে একটা রুমের দিকে গেলো। কালো শার্ট গেলো তার পেছনে। দেখলো রুমে একজন মধ্যবয়সী মানুষ বই পড়ছে। নার্স এর কিছু বলার আগেই বললো কালো শার্ট, “ডক্টর! অ্যাকসিডেন্ট করা ক্রিটিকাল রোগী চারজন! দুইজনের অবস্থা অনেক খারাপ! প্লিজ স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করেন! হাতে একদম সময় নেই! আর…” একটু দম নিয়ে বললো কালো শার্ট, “ফ্যামিলিটা মঞ্জুরুর রহমান সাহেবের! শায়লা ফার্মাসিটিউক্যালস এর মালিক। ফ্যামিলির সবারই…”
ততক্ষণে ডক্টর তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে। বলল, “সিস্টার! কুইক! হাইলি ইমার্জেন্সি! আপনি জানেন কি করতে হবে এখন!” বলতে বলতে তিনি দৌড়ে গেলেন বাইরের দিকে; পেছনে কালো শার্ট!
বাইরে গাড়ির কাছে এসে ডক্টর দেখলেন একটা লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অস্থির পায়চারি করছেন একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তিনি দেখামাত্র চিনতে পারলেন। অনেকবার টিভিতে, পত্রিকায় দেখেছেন! ততক্ষণে স্ট্রেচার, লোকজন চলে এসেছে। মঞ্জু সাহেব ডক্টরের তৎপরতায় ভরসা রাখলেন।
একে একে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো ভেতরে।
কিছুক্ষণ পরে মঞ্জু সাহেবের ভেঙে যাওয়া হাত প্লাস্টার করে গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হলো। দেয়া হলো পেইন কিলার। শায়লার পায়ের হাড় ভেঙেছে, ভেঙেছে ডান হাতও। তারও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে একটা বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ব্যাথায় কাৎরাচ্ছেন! নিঃশব্দে কাঁদছেন তিনি; দুই ছেলের জন্য।
মঞ্জু সাহেব এবং শায়লা; কেউই জানেনা ছেলেদুইটার অবস্থা এখন কি! অপারেশন থিয়েটারে একসাথে দুইজন নেয়ার নিয়ম নেই। সেখানে তবুও একসাথে দুইজনকেই নেয়া হয়েছে। অন ডিউটি ডক্টর আরো তিনজন ডক্টরকে ফোন দিয়ে জরুরী ভিত্তিতে ডেকে এনেছেন। তাদের নিয়ে ঢুকেছেন ও.টি. তে।
মঞ্জু সাহেব মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করছেন। চরম ভাবে হতাশ দেখাচ্ছে তাকে। তার বিধ্বস্ত গাড়িটার ড্যাশবোর্ডের ভেতরে রাখা ছিলো তার ওয়ার্কিং ডায়েরী। সেখানে ছিলো সব গুরুত্বপূর্ন নম্বর। সেটা সেখানেই রয়ে গেছে। তখন কাছে থাকলে তিনি অনায়াসেই একটা ইমার্জেন্সি হেলিকপ্টারের ব্যাবস্থা করতে পারতেন!
তিনি মাথায় হাত দিয়েই বসে থাকলেন।
চলে গেছে মাইক্রোবাসের সেই ছেলেগুলো। থাকার কথাও না! আজকাল মানুষ এটুকুও সাহায্য করেনা কাউকে। তিনি নিশ্চিত যখন মাইক্রোবাসটা তাদের একসিডেন্ট হওয়া গাড়িটা দেখে থেমেছে, তার আগে অন্তত দশ-১৫ টা গাড়ি পাশ দিয়ে হুশ করে তাদের না দেখার ভান করে বেরিয়ে গেছে।
তিনি হঠাৎ টের পেলেন তিনি তাদের ধন্যবাদও দেননি; এমনকি নামটাও জিজ্ঞেস করেননি কারো।
নিজের কাছে খারাপ লাগলো খুব হঠাৎ করে।
একটু পরে একজন ডক্টর বের হয়ে এলো। তার মুখ দেখে কিছু বোঝা গেলো না। তিনি এসে মঞ্জু সাহেবকে বললেন, “ইমার্জেন্সি ডিসিশন নিতে হবে স্যার। মন দিয়ে শুনুন কি বলি। দুই ছেলেরই সিচুয়েশন হাইলি ক্রিটিকাল। খুব সহজ বাংলায় বাঁচানো খুবই কঠিন! দুইজনের শরীর থেকেই প্রচুর পরিমানে রক্ত বের হয়ে গেছে। মাথায় ক্রিটিকাল আঘাত আছে দুইজনেরই। ফিমার, টিবিয়া-ফিবুলা দুইজনেরই ভেঙে গেছে। দুইজনেরই পাঁজরের হাড় ভেঙেছে ৪-৫ টা। সব মিলিয়ে বলতে চাই যে দুইজনেরই অবস্থা প্রায় একই রকম ভাবে খারাপ; কিন্তু খুব বেশি খারাপ! অক্সিজেন দিয়ে রেখেছি। কিন্তু শরীরে রক্ত বেরিয়ে গেছে প্রচুর! শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারবো কিনা তা বলতে পারিনা। কিন্তু বাঁচানোর আশাটা আপাতত বাঁচিয়ে রাখতে হলে দরকার প্রচুর রক্ত। কিন্তু আমাদের এখানে যেই অল্প কয়েক ব্যাগ আছে, তাতে AB- রক্ত নেই। লাগবে হলো AB-! রক্ত পেতে হলে এবং ইমার্জেন্সি চিকিৎসাটা দিতে হলে ঢাকা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু তাতে যেই টাইমটা লাগবে ততক্ষণ…ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং…আমরা দুইজনের একজনকেও বাঁচাতে পারবোনা! এই হচ্ছে অবস্থা। স্যার! আমাদের পক্ষে আসলেই রক্তের ব্যবস্থা করা সম্ভব হছে না! আমরা দুঃখিত! এখন আপনার কাছে কোন উপায় আছে কিনা সেটা যদি বলেন! আপনাদের দুইজনের কারো AB- রক্ত কিনা তা জানিনা। কিন্তু আপনাদের শরীরের যে অবস্থা তাতে আপনাদের কাছ থেকেও রক্ত আমরা নিবোনা। তাই সেটা আর জানতে চাইছিনা!”
সব কথা মঞ্জু সাহেব যেমন শুনছিলেন তেমন শায়লাও শুনছিলেন। শায়লা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন সব শুনে। তিনি বা মঞ্জু সাহেব চাইলেও পারতেন না রক্ত দিতে। তাদের কারোরই AB- রক্ত না!
মঞ্জু সাহেব শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি এই শেষ বয়সে এসে তার সাজানো সংসারটা এভাবে চোখার সামনে ভেঙে যেতে দেখছেন, কিন্তু কিছু করতে পারছেন না! তিনি এটা মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। তার সাতাশ বছরের সাজানো সংসার! বড় ছেলেটা আর কয়েকদিনের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হতো! তার বাবার থেকেও সফল হতো জীবনে! তার এতো বড় ব্যাবসার হাল ধরারও কি কেউ থাকবেনা শেষ পর্যন্ত? তিনি তাহলে কার জন্যে এতো টাকা করেছেন? কার জন্যে করেছেন এতো সম্পত্তি? তিনি সারাজীবনে অসংখ্যবার বহু ক্রিটীকাল অবস্থায় পড়েছেন। সব সময় বিশ্বাস করেছেন যে যেই পরিস্থিতিতেই পড়েন না কেন, উপায় একটা থাকবেই। জীবনে প্রথমবার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না! তার অসম্ভব শক্ত মনটাও এখন ভেঙে পড়তে চাইছে! তিনি ভাবলেন একবার শেষ চেষ্টা করবেন। শেষবার মাথা ঠান্ডা করে একটা উপায় খুঁজবেন।
“আমাকে দশ মিনিট সময় দিন ডক্টর! আমি আপনাকে দশ মিনিটের মধ্যে জানাচ্ছি আমার সিদ্ধান্ত।” বললেন মঞ্জু সাহেব!
“জ্বি স্যার! আমি রুমের বাইরে অপেক্ষায় আছি!” উত্তর এলো।
মঞ্জু সাহেব প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। সিগারেট আর লাইটার হাতে নিলেন। তোয়াক্কা করলেন না দেয়ালে “ধুমপান মুক্ত এলাকা” লেখাটা। একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি কয়েকবার ধোঁয়া ছেড়ে তিনি মাথা নিচু করলেন। তাকে দেখলে মনে হবে তিনি বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভাবছেন মঞ্জু সাহেব!
শায়লার কান্না আর বিড়বিড় করে প্রলাপ তাকে বিরক্ত করছে কিন্তু ভাবনায় বাধা দিতে পারছে না! তিনি ঝাড়া ছয় মিনিট মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর মাথা উঁচু করে চেয়ারে হেলান দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেট ধরালেন। তখনো চোখ বন্ধ তার!
তখনো ভাবছেন তিনি!
দশ মিনিট পার হওয়ার আগেই তিনি সিগারেট ফেলে উঠে দাড়ালেন। শায়লার দিকে তাকিয়ে আস্তে নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা খুলে রুম ত্যাগ করলেন।
তিনি সব ফিরে পাওয়ার কোন উপায় পাননি। বিধাতা বড় কঠিন চাল চেলেছে এইবার।
কিন্তু তিনি সব হারাতে দেবেন না কিছুতেই! ক্ষতি কিছুটা কমানোর উপায় তার কাছে আছে।
অবশ্যই আছে! রুম থেকে বেরিয়ে তিনি ডাকলেন, “ডক্টর…!!”
ডক্টর একটা চেয়ারে বসে ছিলো। উঠে আসলো তাড়াতাড়ি! “জ্বি স্যার! বলুন!”, বললো ডক্টর।
“আমি আপনাকে যে কথাগুলো বলবো এখন; তাতে আপনি দয়া করে অবাক হবেন না, আমাকে কোন প্রশ্ন করবেন না! আপনি আমার থেকেও ভালো করে জানেন যে হাতে একদমই সময় নেই! ঠিক আছে?” একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন মঞ্জু সাহেব।
“অবশ্যই স্যার!” একটু গলা কেঁপে গেলো ডক্টরের।
“শুনুন…” একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করলেন মঞ্জু সাহেব “আমার দুই ছেলের অবস্থা একই রকম খারাপ সেটা তো বললেন। কিন্তু এদের মধে কার অবস্থা তুলনামূলক ভালো? কি মনে হয়? ড্যামেজটা কার বেশি হয়েছে? পর্যাপ্ত রক্ত পেলে বাঁচার আশা কার কতোটুকু?”
“আপনার ছোট ছেলের…আই থিঙ্ক! ওর পাজরের হাড় কয়েকটা বেশি ভেঙেছে। রক্তও বেশি বের হয়ে গেছে তার! কিন্তু কেন স্যার? আপনি কি করার কথা ভাবছেন?” , ভ্রু কুঞ্চিত ডক্টরের।
“তারমানে আমার বড় ছেলের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি?” জানতে চাইলেন মঞ্জু সাহেব।
“আক্ষরিক অর্থে অনেকটা তাই! কিন্তু এইসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?” অনেকটা অসহিষ্ণু ডক্টরের কণ্ঠ! “আমি বলেছিলাম আমাকে প্রশ্ন করবেন না কোন! যা হোক, আমি আপনাকে উপায় বলবো, আপনি ব্যাবস্থা করবেন! কি বললাম কিংবা আমার কথা কতোটা যুক্তিযুক্ত তা ভাবার দরকার নেই!” একটু দম নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন মঞ্জু সাহেব। জীবনের সব থেকে বড় ভুল অথবা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন তিনি…“দেখুন! আমি আমার দুই ছেলেকে একসাথে হারাতে চাইনা। কোন বাবাই চায়না। আমি জানি এখন যে অবস্থা তাতে কারো বাঁচারই তেমন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার অন্তত একটা ছেলেকে বাঁচানোর ব্যাবস্থা আপনি করবেন…একটা ছেলেকে মেরে ফেলে হলেও!”
কিছুক্ষণ দুইজনই চুপ।
“কাজটা কিভাবে করবেন বলে ভাবছেন স্যার?” আস্তে করে প্রশ্ন করলো ডক্টর। তার কণ্ঠে স্পষ্ট একটা হতাশার ছাপ!
“আমার দুই ছেলের রক্তের গ্রুপই AB-! আপনি ছোট ছেলের থেকে আমার বড় ছেলেকে রক্ত দিবেন। যতটুকু লাগে। ছোট ছেলের শরীর থেকে বড় ছেলেকে রক্ত দিন! যাতে বাঁচার আশাটা অন্তত বেঁচে থাকে!…” আবার একটু দম নিয়ে বললেন মঞ্জু সাহেব, “আর আপনার মোবাইলটা একটু দিন প্লিজ!”
হতভম্ব ডক্টর পকেট থেকে বের করে দিলো মোবাইলটা।
“আপনার সিমটা খুলে দিন প্লিজ! আমি একহাত দিয়ে পারবোনা খুলতে।” আদেশ করলেন মঞ্জু সাহেব!
ডক্টর বিনা বাক্য ব্যায়ে তার সিম খুলে দিলো। এইরকম ব্যক্তিত্বের সামনে তার আর প্রশ্ন করার ক্ষমতা নেই কোন।
“এইবার এই মোবাইলটা থেকে সিমটা খুলে নিয়ে আপনারটাতে লাগান।” মঞ্জু সাহেব পকেট থেকে মৃত মোবাইলটা বের করে দিলেন ডক্টরের হাতে।
ডক্টর মঞ্জু সাহেবের সিম খুলে নিজের মোবাইলে লাগালেন। অন করে সেটটা মঞ্জু সাহেবের হাতে দিলেন। সেট হাতে নিয়ে কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকলেন মঞ্জু সাহেব।
ডক্টর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন মঞ্জু সাহেবের চোখে-মুখে প্রথমে সস্তি আর পরে নিদারুন হতাশা এসে ভর করলো। তিনি মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর একটা নম্বরে ফোন দিলেন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই ওপার থেকেই শোনা গেল কিঞ্চিত আতংকিত একটা অনুগত কণ্ঠ, “স্ল্যামালাইকুম স্যার! স্যার এতো ভোরে? কোন সমস্যা স্যার?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম শফিক!……” তারপরের কিছুক্ষণ মঞ্জু সাহেব ঝড়ের বেগে কিছু কথা বললেন। শফিক নামের লোকটা, যে কিনা মঞ্জু সাহেবের পার্সোনাল সেকরেটারী; সেও সব বুঝে গেলো কি করতে হবে। মঞ্জু সাহেব ঠিক এক মিনিট ছয় সেকেন্ডের মাথায় লাইন ডিসকানেক্ট করলেন। তার ৫ মিনিটের মাথায় শফিক ফোন করলো মঞ্জু সাহেবকে, “স্যার! হেলিকপ্টার রওনা হয়ে গেছে। আমি ঢাকায় ব্যাবস্থা করছি স্যার সবকিছুর! আপনি চিন্তা করবেন না স্যার!”
“থ্যাঙ্ক ইউ শফিক!” বলে ফোন রেখে দিলেন মঞ্জু সাহেব!
“ডক্টর! আপনি এইবার তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করুন! প্লিজ!” তাড়া দিলেন তিনি!
“জ্বি স্যার!” বলে অ্যাপ্রনের আস্তিন গোটাতে গোটাতে অনেকটা দৌড়েই অপারেশন থিয়েটারে রওনা করলো ডক্টর। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়! একটা মানুষ কিভাবে এইরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে!? কিভাবে?!
মঞ্জু সাহেব শায়লার রুমে ঢুকে দেখলেন শায়লা ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের মধ্যেই তার মুখে স্পষ্ট যন্ত্রনার ছাপ।
মঞ্জু সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার যেটুকু করার ছিলো তিনি করেছেন। এখন বাকিটুকু সৃষ্টিকর্তার হাতে। সৃষ্টিকর্তা তার অনেক বড় পরীক্ষা নিচ্ছেন। তিনি শুধু পাশ মার্কের অ্যানসার করেছেন। জানেননা পাশ করবেন কিনা।
তার অবচেতন মনে বারবার তার ছোট ছেলের প্রাণোচ্ছল মুখটা ভেসে উঠতে চাইছে। বারবার মনে হচ্ছে ছোট ছেলেটা চিৎকার করে…হাহাকার করে বলছে তাকে, “এটা কি করলেন বাবা! কি করলেন এটা? আমি তো বাঁচতেও পারতাম হয়তো! নিজে হাতে মেরে ফেললেন আমাকে আপনি! নিজে হাতে! বাবা হয়ে সন্তানকে মেরে ফেললেন আপনি! কি করলেন এট আপনি বাবা!?”
কিন্তু তিনি মন থেকে ভাবনাগুলো সরিয়ে দিতে প্রাণপন চেষ্টা করছেন! তিনি জীবনে কখনো আবেগতাড়িত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেননি। এখনো তিনি সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আবেগকে বুকের মধ্যেই তালা-বদ্ধ করে রেখেছেন। মাথায় এসে চিন্তা-ভাবনায় বাধা দিতে দেননি! তিনি জানেন এই পরিস্থতিতে তার এর থেকে যৌক্তিক কিছু করার ছিলোনা!
শায়লার মুখের দিকে তাকালেন আবার তিনি। ঘুমাচ্ছে তখনো। তাকে কি ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা দেবেন তিনি? নাকি ঘুম ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? শায়লা কি করবে এই খবর শুনে?
আরো কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি।
না! শায়লাকে কিছুতেই এই খবরটা দেয়া যাবেনা! কিছুতেই না। শায়লা প্রচন্ডভাবে রিঅ্যাক্ট করবে! আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে। তাকে কিছুতেই সত্যিটা জানাবেননা তিনি। কিছুতেই না!
তিনি বা শায়লা কেউই জানলেন না তখন অপারেশন থিয়েটারে কি ঘটছে।
আস্তে আস্তে রায়হান নামের প্রাণোচ্ছল চঞ্চল ছেলেটার অজ্ঞান দেহ প্রাণহীন হয়ে পড়ছে।
মনটাকে পাথর বানিয়ে ডক্টর চারজন কাজ করে চলেছে। একটা সময় একজন ডক্টর আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলো, “মঞ্জু স্যারকে কি খবরটা দিবো?”
“না! একবারে দুইজনেরই খবর দেবো উনাকে। আল্লাহ ভরসা!” উত্তর দিলো আরেকজন!
কিছুক্ষন পরে দেখা গেলো রাফসানের রক্তচাপ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পালস-রেইটও নিয়মিত হচ্ছে আস্তে আস্তে।
ডক্টররা সবাই একসাথে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলেন।
সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একসাথেই…!
প্রথমবার তাদের কারো জীবন বাঁচানোর কারনে নিজেদের ভীষনভাবে অপরাধী মনে হচ্ছে।
__________________________________________________________________________
নার্সরা স্ট্রেচারে করে শায়লার ঘুমন্ত দেহ হেলিকপ্টারে ওঠানোর সময় মঞ্জু সাহেব বললেন, “একটু দেখে! এখন যেন কিছুতেই শায়লার ঘুম না ভাঙে!”
একজন নার্স বললো, “জ্বি স্যার! ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়া আছে! ভাংবে না!”
একটু পরে একটা হেলিকপ্টার ছোট্ট হাসপাতালটার প্রাঙ্গন থেকে উড়ে চললো ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেখানে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি অত্যাধুনিক হসপিটাল আর কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডক্টর।
উড়ে চলেছে হেলিকপ্টার!
তিনটা দেহ আর…একটা লাশ নিয়ে!
হঠাৎ মঞ্জু সাহেব ডুকরে কেঁদে উঠলেন…!
(No subject)
🙁 :মনখারাপ: :মনখারাপ:
ফিনিশিং ঠিক হইলো কিনা চিন্তায়
ফিনিশিং ঠিক হইলো কিনা চিন্তায় আছি! :চিন্তায়আছি:
কষ্ট পাইলাম ভীষন….
কষ্ট পাইলাম ভীষন….
লেখার সময় আমারও কষ্ট লাগছিলো!
লেখার সময় আমারও কষ্ট লাগছিলো!
চমৎকার লাগলো ।। একজন
চমৎকার লাগলো ।। একজন সাধারন বাবা কে আপনি অভিনব দৃষ্টিকোন থেকে লজিক্যাল বাবায় পরিণত করেছেন ।।
ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ! 😀
দারুণ লিখেছেন। গল্পের বর্ণনা
দারুণ লিখেছেন। গল্পের বর্ণনা খুবই ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ! 🙂
চমৎকার গল্প।
চমৎকার গল্প।
মিস করছিলাম। খুবই ভালো লাগছে।
মিস করছিলাম। খুবই ভালো লাগছে।
দারুণ তো। টান টান উত্তেজনা!
দারুণ তো। টান টান উত্তেজনা! এই গল্প নিয়ে একখান মুভি বা নাটক বানাইলে হিট হতো।