আমার বসবাসের এলাকাটিকে আমি কখনোই খুব একটা পছন্দ করতাম না। অসংখ্য নিম্নবিত্তের বসবাস এই এলাকায় কিন্তু সে কারণে আমার এই পাড়া অপছন্দ তা না। এত নিম্নবিত্তের মাঝে কিছু বিত্তবান তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ বাস করে। যারা সংকীর্ণ মনা এবং স্বার্থচিন্তায় ব্যস্ত। এর বাইরে তাদের আরেকটি কাজ আছে। নিজেদের বিদ্যা যাহির। ঐ সহজ সরল নিম্নবিত্তদের শিক্ষার গৌরব দেখিয়ে স্বার্থ হাসিল করা আর পারলে ভুল শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। এদেরকে কখনোই কিছু বলা যায় না। নিরেট মুর্খদের বলা যায় কিন্তু এসব শিক্ষিত মুর্খদের কিছু বললে তারা বলে, ‘আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন?’। তখন কোন তর্ক করার থাকে না কারণ সংখ্যার দিক দিয়ে এই এলাকায় নিন্মবিত্তের পরই এদের স্থান। সুতরাং এদের সাথে তর্কে যাওয়া মানে নিজের অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া। তাছাড়া এদের কথায় প্ররোচিত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও অনেক। সে যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে যাই। আমার বাসার আশেপাশে অনেক বস্তি। সমুদ্রের মাঝে দ্বীপ উঠলে যেমন হয় আমার বাসাটাও তেমনিভাবে দাঁড়িয়েছে। ছোট তিনতলা বাসা। বাসার বারান্দায় দাঁড়ালে বস্তির দিনমজুর মানুষদের বিভিন্ন কাজ দেখতে পাওয়া যায়। আমি প্রায়ই অবসরে এখানে দাঁড়িয়ে সেসব দেখি।
সন্ধ্যে হবে হবে ভাব। আমি পড়ছিলাম আমার ঘরে। হঠাৎ বিকট চিকার। এক মহিলার কান্নার শব্দ। চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। ‘ও আল্লাগো’ বলে ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার দিচ্ছেন। এরকম জোরে কান্না কেউ মারা গেলে শোনা যায়। কিন্তু সেই কান্না অন্যরকম। সেখানে বাঁচানোর আকুতিতে কোন চিৎকার থাকে না। আমি তাড়াতাড়ি বারান্দায় গেলাম। দেখলাম গলির মুখে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। আর গলির ভিতরে একটা বাড়ি থেকে এই শব্দ। আমি তখনো ঠিকমত বুঝতে পারিনি ঘটনাটা। কিন্তু গলির মুখে দাঁড়ানো মানুষদের কথায় বুঝতে পারলাম।
– এমনে কেউ মারেনি?
– ঐ শুয়ো** বাচ্চা। কি করতাসোস? মরব তো।
– অয় বাড়ায়া আয়। মহল্লা উইঠা গেসে।
– কি হইসে? এমনে মারতেসে ক্যান?
এরকম অনেক কথা অনেকজন বলছে। কিন্তু কেউ গলির ভেতর ঢুকেনি তখনও। বাইরে থেকে হাঁক ঢাক দিচ্ছে। পাড়ার সেই স্বার্থান্বেষী মহলের দু’একজন তখন ভিড় করেছে। উচুঁ গলায় গালি দিয়ে ধমক দিচ্ছে। কিন্তু তখনো ভেতর থেকে সেই একই আওয়াজ আসছে। কোন পরিবর্তন নেই। এরকম খুব সম্ভবত আরো দু’মিনিট চলল। তখন একজন বুড়ো গোছের লোক ভেতরে গেল। তার পেছনে আরো কয়েকজন গেল। সরাসরি ঘরে ঢুকে গেল (বস্তির ঘরগুলো সাধারণত উন্মুক্ত থাকে, এটাও তেমন ছিল)।
– অয় থাম। কি হইসে?
কোন উত্তর নাই। মেরেই চলেছে বোধহয়। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি না। শব্দ শুনছি।
– কি রে? **** ** তোরে কি কইলাম? গতরে লাগে নাই?
– আমার বউ। আপনারা যান।
– কি কইলি? তোর বউ? মারা থামা তারপর তোরে দেখাইতেসি।
আশেপাশ থেকে আরো কয়েকজন- ওয় থামা।
– থামা কইলাম।
কোন ভ্রুক্ষেপ করেনি বোধহয়। তখনো মহিলা কেঁদে চলেছে। এমন সময় ঐ পিশাচকে টেনে ঘর থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করল কয়েকজন। সন্ধ্যের আলোতে পরিস্কার দেখতে পারছিলাম না। তবে যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হল লোকটাকে বের করে আনা হচ্ছে কিন্তু লোকটা শক্তে হাতে মহিলার চুল ধরে টানছে।
– অয় ছাড় শুয়ো** **।
– ছাড়োস না ক্যা?
তবু যখন ছাড়ছে না। মাতব্বর গোছের লোকটি একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। তিনি নিজেই লোকটাকে মারতে শুরু করলেন। লোকটা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তিনি হতভম্ভ হয়ে মহিলার চুল ছেড়ে দিলেন। আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আরো দু’জন ঐ লোককে বাইরে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেলেন। গলির মুখে একের পর এক কথা বলছে মানুষজন।
– কি হইসিল? মারতেসিলি ক্যা?
– সেই কখন থেকে শুনতেসিলাম। কইলাম মারিস না। থামায় নাই।
– কি রে কস না ক্যা?
– আর কি কইতেসিলি তোর বউ?
এতক্ষণে লোক মুখ খুলল। – হ, আমারই তো বউ।
– তোর বউরে মারতেসস তয় সারা পাড়া যে জাইগা গেল?
– ঐ *****রে ধরেন।এত জোরে চিল্লাইসে ক্যা?
– ***** ** তুই এত মারতেসস ক্যা? অয় আরেকটা কথা কবি বা কিছহু করবি তোর কইলাম খবর কইরা দিমু। এই মহল্লায় যা খুশি চলে না। আরেকটা শব্দ যদি শুনি তয়লে……
অন্য একজন বলল-মুরুব্বি, ওরে আরো কয়েকটা লাগায়া দেন না ক্যা?
– না হইসে। তয় আর কিছহু করলে…
বলে তিনি ঠাস করে আরেকটা থাপ্পর লাগিয়ে দিলেন লোকটার গালে। আমি ঠিক মিলাতে পারলাম না। কিন্তু এরপর কয়েকজন ফুসফাস করতে করতে চলে গেল। লোকটা ঘরে আর গেল না। কোথায় জানি মিলিয়ে গেল। সবাই চলে গেলে আমিও বারান্দা থেকে ফিরে এলাম। ভাবতে থাকলাম কি কি ঠিক আর কি কি ভুল ঘটল। কাউকেই শারীরিক অত্যাচার করা ঠিক না। কিন্তু যে ঘটনাটা ঘটছিল তার এমন উত্তর খারাপ না। এটা উচ্চমানসিকতার লোকদের পাড়া না। এখানে বউপেটানোকে জায়েয ধরা হয়। তবে সীমার বেশি করে ফেললে তাকে এরকম শাস্তি দেওয়া হয়, যেটা আর কিছুতে না হোক এ মহল্লার লোকদের পুরুষত্বে বাঁধে। আমি এ এলাকাকে অপছন্দ করলেও এটুকু সীমাজ্ঞান যে করতে পেরেছে তাকেই সম্মান জানাই। অন্তত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের চেয়ে এই বস্তি পাড়া মানবিকতার দিক দিয়ে তো উন্নত? যেখানে ডাঃ আপসার মত নারীচিকিসককে মুখে রড ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হয় তবু সেই উর্দিপোশাকধারীরা কোন প্রতিবাদ করে না, বরং জানোয়ারের দাম্ভিকতা দেখে হাত তালি দেয় তার চেয়ে নিম্নবিত্তদের এই বস্তি পাড়া তো ভাল? এখানে অন্তত একজন চিকার করে সাহায্য পায়। মাত্রাতিরিক্ত অন্যায়ের শাস্তি হয়। হয়ত আইনী প্রকিয়ায় না। কিন্তু আইনের কঠোর অনুশাসনের ক্যান্টনমেন্ট এলাকার চেয়ে উন্নত উপায়ে হয়। তাই ধিক্কার জানাই সেই ‘উচ্চশ্রেনীর’ উর্দিপোশাকধারী জানোয়ারদের। সামান্য করে হলেও সম্মান জানাই ‘নিম্নশ্রেনীর’ দিনমজুরদের সাথে মুরুব্বি গোছের শিক্ষিত মুর্খদের।
নিম্নবিত্তের কোন মুখোশ
নিম্নবিত্তের কোন মুখোশ থাকেনা। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের আপাদমস্তক মুখোশে ঢাকা।
তা ঠিক। কিন্তু উচ্চবিত্ত আর
তা ঠিক। কিন্তু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তই নিম্নবিত্তদের চালায়। আর সহজ সরল মানুষগুলো ফাঁদে পড়ে।
(No subject)
:তালিয়া: :তালিয়া: :তালিয়া:
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ধন্বিযবাদ। তবে আমি মনে করি
ধন্বিযবাদ। তবে আমি মনে করি বিত্তই অনেক সময় মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়।
উচ্চশ্রেনী কিংবা নিম্নশ্রেনী
উচ্চশ্রেনী কিংবা নিম্নশ্রেনী কোন ব্যাপার না । মূল বিষয় হল কার মানসিকতা কি ধরনের ।
খান সাহেব লেখা ভাল লাগছে । :ধইন্যাপাতা:
ধন্যবাদ. তবে আমি মনে করি
ধন্যবাদ. তবে আমি মনে করি বিত্তই অনেক সময় মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়।
(No subject)
:থাম্বসআপ:
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ