কবি রাসেল রায়হানের পোস্ট থেকে জানতে পেলাম, যাত্রাবাড়ির মারকাজুত তাহফিজ ইসলামিয়া ক্যাডেট মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ মোহাম্মাদ তারিকুল ইসলাম দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কোরআন পাঠ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এবারে ২১ তম কম্পিটিশন হয়। এতে ১০৩ টি দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশ প্রথম হয়।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো পুরষ্কারের মূল্যমান। ২ লাখ ৫০ হাজার দিরহাম জিতে নিয়েছে হাফেজ তারিকুল। টাকার অংকে ফিগারটা দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা!!! কী চোখ কপালে উঠে গেলো?
আমার চোখ জায়গাতেই আছে। সৌদি – দুবাইয়ের আমীর – শেখদের তেল বেচা টাকার অংক আমাদের মতো আদার ব্যাপারির কল্পনার বাইরে। ও থেকে উচ্ছিষ্ট বিতরণ করলেও তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া মাদ্রাসা ছাত্রদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার জীবন টানতে হয় না।
আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জায়গা ভিন্ন। কবি রাসেল রায়হান আক্ষেপ করেছেন এমন একটা নিউজ তেমন একটা মিডিয়া কাভারেজ পেলো না দেখে।
অবশ্য তিনি বলেছেন, এরা মিডিয়ার আনুকূল্য খোঁজে না কখনো। অর্থাৎ মাদ্রাসার কৃতী শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের কথা প্রচারের আলো না পেলেও কিচ্ছু যায় আসে না।
যাহোক, খবরটা জানার পর মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। আমার দেশের একটা ছেলে ১০৩ টা দেশকে বিট করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে, এতো বিশাল আনন্দের খবর! কিন্তু একটু পরেই বিষাদে মনটা ভরে গেলো। একটা আশঙ্কা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরলো।
দেশে হাফেজে কোরআনের সংখ্যা ২৫ লাখের মতো। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরা নিতান্ত দারিদ্রক্লিষ্ট পরিবার থেকে আগত কিশোর। সাধারণ শিক্ষায় পড়তে দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ এঁদের বাবা-মায়ের নেই। উলটো মাদ্রাসায় বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে পড়ার সুযোগ আছে। তো এঁদের কাছে শিক্ষা অধিকার তো নয়ই বরং বিলাসিতার নামান্তর।
লাখ লাখ হাফেজের মধ্য থেকে একজন তারিকুল হঠাৎ অভাবনীয় অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে গেলে খুব বেশি আহ্লাদিত হওয়ার কারণ নেই। ব্যক্তি তারিকুলের ইহকালের জীবন নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যমণ্ডিত হলেও অবশিষ্ট তারিকুলরা যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই পড়ে থাকবে। যে তিমিরে কেবল অভাব আর অভাব। অন্যের দয়া দাক্ষিণ্য, করুণা যেখানে প্রধান সম্বল।
তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য – প্রযুক্তির মহাযজ্ঞে একজন হাফেজের অবস্থান কোথায়? তার মুখস্ত বিদ্যা মৃতের মঙ্গল কামনার্থে সুর করে পাঠ করা কিংবা শীতকালীন জলসা কিংবা পরকালের পুরস্কার লাভের হাতছানি ব্যতীত আর কী কী কাজে লাগে? প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্র – নজরুলের কবিতা পাঠ কী কী কাজে লাগে, ওসব গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ কীভাবে উৎপাদনের সাথে জড়িত?
কুতর্ক বাদ দিলে বুঝতে পারবেন একজন মানুষকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে গল্প, কবিতা, ইতিহাস, দর্শনের জ্ঞান লাগে। শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলো হৃদয়ের সবকটি বদ্ধ জানালা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, যাতে চতুর্দিক থেকে আলো প্রবেশ করতে পারে। কোনো একটি সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্যসূচির মধ্যে শিক্ষাকে আবদ্ধ করে রাখলে সেই শিক্ষালব্ধ একজন মানুষ পূর্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এজন্য শিক্ষাকে প্রথমেই সেক্যুলার হতে হয়। একটা স্তর পর্যন্ত সেক্যুলার শিক্ষা প্রদানের পর শিক্ষার বিবিধ কমপার্টমেন্ট খুলে দেওয়া যেতে পারে। তখন কেউ নির্দিষ্ট পছন্দের উচ্চতর শিক্ষা লাভে ব্রতী হোক, অসুবিধা নেই।
তাহলে ২৫ লাখ হাফেজ এই সমাজে কী কী অর্থনৈতিক উপযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম? সে কী কোনোরকম উৎপাদনের সাথে জড়িত? তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আমাদের ওই পরিমাণ হাফেজের প্রয়োজন আছে কী না?
ধরে নিলাম প্রয়োজন আছে। কিন্তু ওই হাফেজ সাহেবদের কি আমরা ‘ পবিত্র কিতাব ‘ মুখস্ত এবং এর তাফসীর শেখার মধ্যেই আটকে রাখবো না কী তাকে উচ্চতর অংক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইংরেজি নিদেনপক্ষে কারিগরি এসব বিষয়ও শিক্ষা দেবো?
যদি তা না দিই তবে কি তারিকুল ইসলামের প্রাপ্ত ইহকালের লোভনীয় পুরস্কারের স্বপ্নে বিভোর হতে আরো লাখ লাখ তারিকুলকে উদ্বুদ্ধ করবো? ১৭ কোটি মানুষের দেশে আমরা সবাই তারিকুল হতে চাইলে রাষ্ট্রপ্রধান মেনে নেবেন? আমাদেরতো মাটির নিচে তেলের সাগরও নেই, পেট্রোডলারও নেই – ১৭ কোটি হাফেজের ভার সইতে পারবো তো আমরা? আমাদের মহা উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, মধ্যম আয় এসব ঠিকঠাক থাকবে তো কোটি কোটি তারিকুলের দেশে?
কিন্তু আমরা তো নিশ্চয়ই জানি ১০ টাকার লটারি টিকিট ৩০ লাখ মানুষ ক্রয় করলেও ৫০ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কার একজনই পায়। লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার লোভে আমাদের একাল চলে গেলো, পরকালে ফার্স্ট হওয়ার গ্যারান্টি আছে তো?
যদি ফার্স্ট হওয়ার গ্যারান্টি থাকে তবে দ্বিতীয়, তৃতীয় হবে কে? দ্বিতীয়, তৃতীয়’র মনে দুঃখ দেওয়া সেটা তবে কেমন বিচার হবে? সে আল্লাহ ভাল জানেন। আমেন।