আমার মতে জামাত নিষিদ্ধের এই দাবি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বাস্তবতাহিন। ওদের নিষিদ্ধ করলেই কি ওদের সমর্থকরা, যারা যথেষ্ট সংখ্যক ও রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সুসঙ্ঘটিত, ভানিশ হয়ে যাবে? বরং তারা অন্য নামে আত্মপ্রকাশ করবে বা আন্ডারগ্রাঊন্ডে চলে যাবে; তাদের ভোট চলে যাবে অনিবার্য্য ভাবেই জামাত সমর্থক বি এন পির বাক্সে। ১৯৯০ সালের পর প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় আমাদের এই বার্তা দেয় যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমর্থন বা বিরোধিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারের আচরণ। সেই হিসাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে পরবর্তিতে বি এন পির ক্ষমতায় আসা একরকম অনিবার্য্য। সেই পরিস্থিতিতে জামাত নিষিদ্ধকরন কি আদৌ ধোপে টিকবে?
দেশে দেশে রাজনিতির ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি যে জামাতের বা এই ধরনের কোন রাজনৈতিক শক্তিকে হারাতে হলে তাদেরকে রাজনৈতিক ভাবেই পরাভুত করাই একমাত্র স্থায়ি সমাধান। আর তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে হারাতে হলে দেশের সব মানুষকে দুর্নিতি, কুশাসন মুক্ত করে তাদের কাছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষা পৌছে দিতে হবে। যাতে তারা নিজেরাই জামাতিদের কুট কৌশল আর ভ্রান্ত ইসলাম বুঝতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জামাতের যুদ্ধাপরাধি নেতাদের সুদক্ষ প্রসিকিউশন আর আন্তর্জাতিক মানের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়াই হতে পারে তাদের রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান পদক্ষেপ, যা জামাতের নেতৃত্বের অসাড়তা জনসমক্ষে তুলে ধরবে এবং তাদের সমর্থকদের বিশ্বাসের ভিত্তিমুল নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। বিচারের রায় পরবর্তিতে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা, পরাভুত করা অনেক সহজ করে দিতে পারে। আহেতুক ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মত জামাত নিষিদ্ধ করার মত অবাস্তব দাবি তুলে, যুদ্ধাপরাধিদের বিচারকেই আড়াল করে দেওয়া হচ্ছে, তাকে বিতর্কিত করে ফেলা হচ্ছে।
খেয়াল করে দেখেন যারা জামাত নিষিদ্ধের দাবির নেতৃত্বে তারা বেশিরভাগই শহুরে উচ্চ/মধ্যবিত্ত পশ্চিমা শিক্ষায় আর সংস্কৃতিতে শিক্ষিত শ্রেনির, যাদের সাথে দেশের বিশাল বাংলার সাধারন শ্রমজিবি মানুষের যোগাযোগ খুবই কম (কিন্তু জামাতিদের আছে সেই যোগাযোগ। এনারা অন্তর্মুখি, নিজেদের মনকেই চোখ ঠাউরাচ্ছেন, নিজেদের ব্লগ আর ফেসবুক জগতকেই বিশাল বাংলা ভাবছেন। তারা অনেকেই সম্ভবত ক্ষমতার আর দুর্নিতির বেনিফিশিয়ারি (তাদের সন্তান), তাই তাদের মুখে প্রধান দুই দলের আর রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসি দুর্নিতির বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদও নেই, বরং আছে নিরবিচ্ছিন্ন পুলিশি প্রোটেকশন। কে কবে কোথায় কখোনো দেখেছে পুলিশি পড়টেকশনে গনআন্দোলন? অথচ বাংলাদেশের সাধারন মানূষের প্রতিদিনের জিবনসংগ্রামে সবচেয়ে বড় সমস্যা কুশাসন আর দুর্নিতি, আর তারা ব্যাক্তি আর সামাজিক জিবনে পুলিশের প্রোটেকশনের বদলে পুলিশি দুর্নিতি আর নির্যাতনের সাথেই সার্বিকভাবে পরিচিত।
এনারা যেমন করে দুর্নিতির অর্থে গুলশান বারিধারা বানানি আর ডি ও এইচ এর মত বিচ্ছিন্ন সর্গ সুখের দ্বিপ তৈরির স্বপ্নে বিভোর, তেমন করেই বিশাল বাংলার সাধারন শ্রমজিবি মানূষকে পাশ কাটিয়ে, শুধু যুদ্ধাপরাধিদের বিচার আর জামাত শিবির নিষিদ্ধকরনের মাধ্যমেই পশ্চিমা ধাচের প্রগতিশিল গনতান্ত্রিক দেশ বানানোর আশায় বিভোর, যেখানে ওনাদের স্বার্থে দুর্নিতি আর কুশাসন অবাধে চলতেই থাকবে।
ওনারা এটা বোঝেন না যে, তাদের স্বপ্নের পশ্চিমা ধাচের প্রগতিশিল গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ যদি হয় একটা বাগান, তবে তার মাটি হচ্ছে এই বিশাল বাংলার সাধারন শ্রমজিবি মানুষ। সেই সাধারন শ্রমজিবি মানুষ যদি মধ্যযুগিয় কুশাসন, দুর্নিতি, দারিদ্র আর কুশিক্ষায় নিমজ্জিত থাকে তবে সেই মাটিতে কি করে পশ্চিমা ধাচের প্রগতিশিল গন্তান্ত্রিক বাংলাদেশের বাগান বানানো সম্ভব?
এই বিষয়ে আমার আগের পোষ্টগুলিও দেখতে পারেনঃ
সাবধান – জামাত আর ইসলাম একাকার করে জামাতিদের হাতে লাইফ লাইন ধরিয়ে দিবেন না ১৪ ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩
প্রজন্ম চত্বর মঞ্চ থেকে ছাত্র নেতাদের আর ধর্মবিদ্বেষি নাস্তিকদের হটান ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩
প্রজন্ম অভ্যুত্থান যেন ভেসে না যায় – লক্ষ্যকে জিবনসংগ্রামের ভিত্তি দিন, জনমুখি হোন ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩
আপনি কি মনে করেন, আমরা
আপনি কি মনে করেন, আমরা জামাতকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে দিই, আর তারা ক্ষমতায় বসেই ব্লগারসহ সকল মুক্ত চিন্তার মানুষগুলোকে নাস্কিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়ে বাংলার মাটিকে পাকিস্তান, আবগানিস্তান তৈরী করুক ? আর আমাদেরকে নাস্তিক বানিয়ে যখন বিচার করে ফাঁসি কাস্ঠে দাঁড় করাবে তখন আমরা জয় বাংলা বলে জীবণটা দিয়ে দিব ? আর এভাবেই আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানীর ঋণ শোধ হয়ে যাবে ? এজন্যই কি আমাদের পূর্ব পুরুষরা জীবণ বাজি রেখে এদেশ থেকে পাকিস্তানকে বিদায় করে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিল? একবার সরকার জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেই দেখুক না, কোন আন্ডারগ্রাউন্ডে যায় জামাত-শিবির ? জেএমবিও এদেশে ৬৪ জেলায় একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। কি পরিণতি হয়েছে তাদের ? জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা না করলে তাদেরকেও এদশে থেকে বিতাড়িত করা যেত না…
আমি আমার লেখার কথায় জামাতকে
আমি আমার লেখার কথায় জামাতকে ক্ষমতায় বসানোর কথা বলেছি। শুধু নিষিদ্ধ করার কারনেই জে এম বি শেষ হয় নাই। জনসমর্থন না পাওয়ায়ই তারা রাজনৈতিক ভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছে, যা দির্ঘস্থায়ি।
শুধু আইন করে নিষিদ্ধ করেই যদি কোন শক্তিকে দমানো যেত, তাহলে আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করেই পাকিস্তানিরা স্বাধিনতা যুদ্ধকে শেষ করে দিতে পারতো। ফ্যাসিবাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ দমানোর চেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে সবখানেই, পাকিস্থানে আফগানিস্তানেও। আমরা অবশ্যই সেই পথে যেতে চাই না।
১৯৭১ এ ভৌগলিক ভাবে স্বাধিন হলেও, দুঃখজনক ভাবে বাংলাদেশ পুজিবাদি টাকার খেলার রাজনিতি, উপনিবেশিক রাষ্ট্রিয় ব্যাবস্থা আর শাসক গোষ্ঠির উপনিবেশিক-সামন্তবাদি মানসিকতা থেকে কখোনই বেরিয়ে আসতে পারে নাই। স্বাধিনতার সরাসরি সুফল সবই গেছে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শিক্ষিত উচ্চ/মধ্যবিত্ত রাজনিতিক, আমলা, ব্যাবসায়ি আর ইন্ডেনটারদের কাছে। স্বাধিনতার পরেও সাধারন মানুষ এখোনো রয়ে গেছে এদের প্রজা, তারা স্বাধিনতার বেনিফিট যা পেয়েছে তা শুধুই ক্ষমতাসিন গোষ্ঠির লাভের ইন্ডাইরেক্ট ফল হিসাবে। যেমন ধরুন, স্বাধিনতার ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্জাতিক যোগাগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় ম্যানপাওয়ারের ব্যবসায়িরা মুনাফার লোভে এই ব্যাবসার বিস্তার ঘটায় এবং বিভিন্ন দেশে শ্রম রপ্তানি শুরু করে এই দেশের সাধারন মানুষের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে। এর ফলে সাধারন মানুষ কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছে অর্থনৈতিক ভাবে আর দেশ উপকৃত হয়েছে তাদের রেমিটেন্সের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। তবে তাদের অর্জিত অর্থের বেশিরভাগই অপচয় হয়ে গেছে হয় দুর্নিতিপরায়ন শাসক গোষ্ঠির স্বার্থে (ব্যাঙ্ক এবং শেয়ার মার্কেট দুর্নিতির মাধ্যমে) নতুবা অনউৎপাদনশিল খাতে জমি ফ্লাটের দাম বৃদ্ধিতে নতুবা ভোগ্যপন্যে। একই অবস্থা গার্মেন্টস শিল্পে।
এই সামন্ততান্ত্রিক আর উপনেবেশিক কুশাসনেরই পরিনতি আজকের আওয়ামি লিগ বিএনপির লুটেরা ধ্বংসাত্মক রাজনিতি,সর্বগ্রাসি দুর্নিতি আর রাজাকারদের পুনরুত্থান। আর তারই ধারাবাহিকতায়ই হয়েছে শাহবাগের সম্ভবনাময় প্রজন্ম আন্দোলনের অকাল অপমৃত্যু।
আমরা স্বাধিনতার পর থেকে বাংলাদেশের পজিটিভ উন্নয়ন যা দেখেছি তা সবই শত প্রতিকুলতায় বাংলাদেশের সাধারন মানুষের উদ্ভাবনি হার না মানা শক্তিরই ফসল। এতে রাষ্ট্র সরকার রাজনিতিবিদ আর আমলাদের ভুমিকা নিতান্তই নগন্য। বরং তাদের দুর্নিতি এবং আর আমলাতান্ত্রিক নিগেটিভ ভুমিকা না থাকলে সাধারন মানুষ আরো অনেক অনেক বেশি সফল হতেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর জামাতও পেত না পুনরুত্থানের সুযোগ।
এখন আওয়ামি লিগ আর বিএনপির ধামাধরা লুটেরা,ধ্বংসাত্মক আর সর্বগ্রাসি দুর্নিতির রাজনিতি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আর শসন ব্যাবস্থাকে এমন পর্য্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে বা গেছে যে অচিরেই তা জনসখ্যার আর জলবায়ুর পরিবর্তনযুক্ত চাপের সাথে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের একমাত্র আশা সাধারন মানুষের উদ্ভাবনি হার না মানা শক্তিকেও পরাজিত আর হতদ্যোম করে দিবে বলেই মনে হচ্ছে। যার পরিনতি আমাদের ভৌগলিক স্বাধিনতা অর্জনকেই অর্থহিন করে দেবে।
এখন আওয়ামি লিগ আর বিএনপির
একমত।
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ