ভাষা পরিবর্তনশীল। একদিন আমরা যেই বাংলা বলছি, তেমনটা থাকবে না। আর মাত্র ১০০ বছর পরেই বাংলার অবস্থা মন হবার সম্ভাবনা যে আজকের লোকেরা সেটা পড়তে গেলে ভাববেন, এটা নতুন কোনো ভাষা। ভাষা প্রতিনিয়ত নতুন শব্দ গ্রহণ করে। এই পরিবর্তন, আর নতুন অনেক শব্দ, অনেক ধারা আত্মীকরণের এই ব্যাপারটা মানতে হবে।
আমরা শুধু বাংলা বাংলা করি, মনে করি যে বাঙালি মানেই বাংলাভাষী। এইসব করতে গিয়ে আমাদের এই সার্বভৌম ভূখন্ডে যা বাংলা না, তাকেও বাংলাই মনে করি। যেমন, খাস সিলেটি বলা কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তার মাতৃভাষা কী, তবে সে বলবে বাংলা। চট্টগ্রামে গেলে সে অঞ্চলের মানুষও বলবে, আমার মাতৃভাষা বাংলা। তবে তাদের মাতৃভাষা বাংলা না। সিলেট অঞ্চলের কোটিখানেক মানুষের ভাষা ছিলটি, যার আলাদা লিপিও আছে (সিলেটিনাগরী)। চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেড়কোটির বেশি মানুষের ভাষা আসলে চাঁটগাঁইয়া। অসমিয়া ভাষাকে যদি আপনি বাংলা না বলেন, তাহলে ছিলটি বা চাঁটগাঁইয়া ভাষাকে বাংলা বলা হবে অপরাধের পর্যায়ের। বাংলার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী হচ্ছে অসমিয়া।
কোন অঞ্চলের মানুষের ভাষার সাথে যে কার সংযোগ, এটা জানাটাও আকর্ষণীয় ব্যাপার। ভাষা জানতে জানতে ইতিহাসও জানা যায়। আমাদের বাংলা, কিংবা অসমিয়া (অসমীয়া), ছিলটি, চাঁটগাঁইয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া (নামটা সুন্দর), রোহিঙ্গা, চাকমা, রংপুরী এইসব ভাষার শেকড় আসলে একই। সবগুলোই ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা বংশের অন্তর্ভুক্ত। চিন্তা করলে অসম্ভব লাগে যে কোথায় ভারতবর্ষ আর কোথায় ইউরোপ। তবে দুনিয়াটা খুব ছোট জায়গা। একটা মানুষ সারাজীবনে যত কদম পা ফেলে, তা দিয়েই বার কয়েক পৃথিবী চক্কর হয়ে যায়। ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবংশের ইন্দো-ইরানিয়ান শাখার ইন্দো-আর্য থেকে সবচেয়ে কাছের গোত্র পাওয়া যায়। ইন্দো-আর্য ভাষাশ্রেণির পূর্বাঞ্চলীয় ভাষা শাখার বাংলা-অসমিয়া প্রশাখার অন্তর্ভুক্ত উপরে বলে যাওয়া আমাদের চেনা ভাষাগুলো।
হিটলার তো জিপসী বা রোমানিদের মেরে কেটেও সাফ করছিলেন। তাদের ভাষার সাথেও আমাদের অদ্ভুত মিল। এশিয়া মাইনর, সিরিয়া কিংবা ইরান থেকে ভারতবর্ষে মানুষজন এসেছে, আমাদের এদিক থেকে কি ওইদিকে চলে যায়নি কেউ কখনো? রোমা বা রোমানিরাও তো তেমন। এই ভবঘুরে জাতিটা সম্ভবত পাকিস্তান কিংবা রাজস্থান অঞ্চল থেকে ইউরোপে সরে যায় ধীরে ধীরে। সর্বশেষ মাইগ্রেশন ঘটে সম্ভবত সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের সময়। শুরুটা যদিও এরও হাজার বছর আগেই ঘটে বলে ধারণা এখন তাদের ভাষার সাথে সবচেয়ে বেশি মিল কাশ্মীরিদের। মানুষ নিজেদের অতীত জানতে কতকিছুই তো করে। ডিএনএ ম্যাচিং থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে রোমানিরা সম্ভবত ভারতবর্ষের অচ্ছুত দলিতদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দশ, বিশ, শত কে রোমানিরা বলে দেছ, বিছ, ছেই। ইন্দো-আর্য সম্পর্ক খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে প্রাচীন সংস্কৃতে অগ্নি, এখনকার হিন্দী ও বাংলায় যথাক্রমে আগ ও আগুন, রোমাদের ভাষায় যাগ। এত দূরের মানুষের সাথে আমাদের এত কাছের সম্পর্ক। তবুও মানুষ বলে আমরা নাকি আলাদা, জাতিতে জাতিতে অনেক ভাগ। কেন?
কী বলতে গিয়ে কী যে লিখছি। ছিলটি, রংপুরী কিংবা চাঁটগাঁইয়া ভাষা কি বাংলার আগ্রাসনের শিকার না? এই ভাষাগুলোরও বাংলার মত গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল। তবে পশ্চিমবাংলার শাসনেও বাংলাভাষী বাঙালিরা আর আমাদের দেশেও তাই। শাসকশ্রেণির মূলধারার লোকেদের প্রভাব অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘুদের উপর পড়ে। জাতিসত্ত্বা এক হওয়া মানেই যে তাদের ভাষা এক হবে তেমনও নয়। ইংরেজরা, আইরিশরা আর স্কটিশরা আলাদা আলাদা জাতি হিসেবে পরিচিত। তাদের ভাষা ইংরেজী তবে ভাষার ডায়ালেক্ট ভিন্ন। আইরশরা আইরিশ ডায়ালেক্টে কথা বলে, স্কটিশরা নিজেদের ডায়ালেক্টে। জাতিগত পরিচয়ের জন্য ভাষা অভিন্ন উপাদান নয়।
দেশের দুইটা জেলার মানুষের ভাষা বুঝতে আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। একটা জেলা সিলেট, আরেকটা চট্টগ্রাম। দুটা ভাষাকে ভিন্ন ভাষা বলা হবে নাকি সেটা নির্ধারণের একটা উপায় হচ্ছে তাদের মধ্যে মিউচ্যুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি কিংবা পারস্পরিক বোধগম্যতা কেমন। যদি ভাষার দুটা রূপ সহজে বোধগম্য হয়, তবে সেগুলো একই ভাষার ভিন্ন ডায়ালেক্ট। এই মিউচ্যুয়াল ইন্টেলিবিলিটির হিসেবে বাংলার সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হচ্ছে অসমীয়া। ছিলটি বা সিলেটি হচ্ছে অসমীয়ার থেকেও বেশি দূর্বোধ্য আর চাঁটগাঁইয়া ভাষা তো আমার কাছে তামিলের কাছাকাছি লাগে। তাদের ভাষার বাক্যের গঠনে, উচ্চারণে ও নানা ব্যাপার স্যাপার মিলিয়ে বাংলা থেকে বেশ আলাদা। তাদের শব্দসম্ভারও অন্যরকম, অনেক শব্দ যেমন এক, আবার অনেক শব্দ একদম আলাদা। ছিলটিতে যেমন স্বরবর্ণ ৬ টা। আমাদের তো আরও বেশি। চাঁটগাইয়াতেও আমাদের থেকে কম। ছিলটি লেখা হয় সিলেটিনাগরী লিপিতে। একসময় বহুল প্রচলিত ছিল, এখন হারাতে হারাতে আবার ফিরে আসছে থ্যাংকস টু লন্ডন প্রবাসী সিলেটিজ। চাঁটগাঁইয়ারা লিখত ইস্টার্ন নাগরীতে, এখন কেউ-ই মনে হয় লিখে না। বাংলার মত ছিলটি, চাঁটগাঁইয়া, রোহিঙ্গা; এসব ভাষার আইএসও কোড আলাদা। এসব ভিন্ন ভাষা হিসেবে ইতিমধ্যে স্বীকৃত। আপনারা যারা সিলেটের তারা ছিলটি-ই বলেন, বাংলা বলেন না যারা অকৃত্রিম চাঁটগাঁইয়াতে কথা বলেন, তারাও নিজেদের ভাষাতেও বলেন, ওইটা বাংলা না। না মানলে নাই, কিন্তু সত্য এটাই। সত্য এটাই যে ওই অঞ্চলের স্বল্প ও উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা এখন দুইভাষাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
ভাষার আঞ্চলিক রূপ অথবা বিপন্ন ভিন্নভাষাগুলোর জন্য আমার মায়া লাগে। রাষ্ট্রের অনেককিছু স্ট্যান্ডার্ডাইজ করতে অভিন্ন করা প্রয়োজন হয়, কিন্তু যেগুলো স্বকীয় ছিল সেগুলোর সাথে কতকিছু যে মিশে আছে! মায়াই লাগে...
ভাষাও মানুষের মত, জন্ম নেয়, ধীরে ধীরে পরিণত হয়, তারও স্বভাব বদলায়, আবার একটা না একটা সময় মরেও যায়। ভবিষ্যতের জন্য রেখে যায় তার বীজ, মানুষ যেমন তার বংশধর রেখে যায়। এই প্রক্রিয়া একটা স্বাভাবিক, স্বতস্ফুর্ত প্রক্রিয়া। তবে নাতীনাতনীরাও যেমন দাদা নানার পালংকটা যত্ন করে ধরে রাখে, পরিবারের অনেক ব্যাপারস্যাপার নিজেদের মধ্যে ধারণ করে, হারাতে দিতে চায় না। এই ভাষারগুলোর যত্নও তারা নিজেরাই নিক। কোটিকোটি মানুষের যেই ভাষা, এত সহজে অন্যকিছুর প্রভাবে নিজেদের হারানোটা ঠিক লাগে না আমার কাছে।
- আমি অথবা অন্য কেউ এর ব্লগ
- 275 বার পঠিত
Comments
Post new comment